ধারাবাহিক গল্প

শ্রাবণ আঁধারে পর্ব ১১

কলমে নিশাত জাহান নিশি

 

চিএার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি অদ্ভুত এক ঘোরে ডুবে গেলাম। তৎপর হয়ে পড়লাম পুনরায় চিএাকে নিজের করে নিতে। সারা রাত চিএার সাথে কাটিয়ে আমি ভোরের দিকে বাড়ি ফিরে এলাম। স্নান সেরে নিশ্চিন্ত মনে গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়লাম।

দুপুর ঠিক ১২ টায় আমার ঘুম ভাঙ্গল। মূলত দরজার খটখট শব্দে আমার কাঁচা ঘুমটা হুড়মুড়িয়ে চোখ থেকে উবে যেতে বাধ্য হলো। চোখ, মুখ কুঁচকে আমি প্রখর বিরক্তি বোধ প্রকাশ করে চিৎ হয়ে শোয়া থাকা অবস্থা থেকে ধপ করে উঠে বসলাম। আধো চোখে তিক্ততা নিয়ে আমি দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে ক্ষীন কন্ঠে চেঁচিয়ে বললাম,,

“কে?”

দরজার ঐ পাশ থেকে চিএার কন্ঠস্বর আমার কর্ণ কুহরে মিষ্টিভাবে প্রতিধ্বনিত হলো। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রিয় মানুষটার কন্ঠস্বর শ্রবণ করা মাএই আমি হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে চোখ দুটো কচলে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা খুলে দিলাম। ম্লান হাসিতে, পুরো মুখে লাল রং মাখা অবস্থায় চিএাকে দর্শন করা মাএই আমার বুকের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। আগ পাছ না ভেবে আমি চিএাকে হেচকা টান দিয়ে রুমে ঢুকিয়ে তাড়াহুড়ো করে দরজার খিলটা আটকে দিলাম। চিএা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে পেছন থেকে আমাকে ডেকে বলল,,

“ইসসস। কি করছিস তুই? জেঠু, জেঠিমারা কোনো মতে দেখে নিলে সন্দেহ করবেন তো!”

বাতাসের বেগে আমি পিছু ঘুড়ে চিএাকে আষ্টেপৃষ্টে ঝাপটে ধরে চোখ জোড়া বুজে ভেতরটায় প্রখর শান্তি অনুভব করে গলা জড়ানো কন্ঠে বললাম,,

“তোকে ছাড়া আমার একটা মুহূর্ত ও ভালো লাগে না চিএা। ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ বেঁধেছে বোধ হয়। আমি এই ভয়ঙ্কর অসুখ থেকে অতিশয় মুক্তি চাই চিএা। প্লিজ আমাকে মুক্তি দে। আমার সাথে আজই কাশিয়ানী ফিরে চল প্লিজ।”

চিএা হালকা হেসে বলল,,

“কিভাবে আমি মুক্তি দেই বল তো? তোর সাথে কাশিয়ানী গেলে ও হয়তো তুই একই ভাবে এই ভয়ঙ্কর অসুখে কাতরে মরবি। ভালোবাসা মানেই তো এক দুরারোগ্য অসুখ আরাধ্য। কাছে বা দূরে থাকলে ও এই একই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এর থেকে সম্ভবত কোনো নিস্তার নেই। তবে একটা পথ খোলা আছে জানিস? এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার!”

আমি কাকুতি ভরা কন্ঠে বললাম,,

“কি পথ? বল না চিএা?”

চিএা সারল্য কন্ঠে বলল,,

“মৃত্যু! মরতে পারবি আমার জন্য? বিনিময়ে আমি ও তোর জন্যে মরতে রাজি!”

থমকালাম আমি। শরীরের সমস্ত বল ছেড়ে দিয়ে আমি ভাবশূণ্য হয়ে চিএাকে ছেড়ে নির্বোধ দৃষ্টিতে চিএার দিকে তাকালাম। ক্ষনিকের মধ্যে চিএা মৃদ্যু হেসে হাত ভর্তি লাল রং আমার দু গালে মেখে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বলল,,

“শর্মিষ্ঠার বিয়েতে রং খেলতে এসেছিলাম। সেই রং তোকে মাখালাম। এই নিয়ে দুবার আমি তোকে রং মাখিয়েছি। বল বিনিময়ে কি দিবি?”

চিএার দুষ্টু, মিষ্টি কথাটাতে ও রাগ যেনো আমার মাথা থেকে নামছেই না। উল্টে লেলিহান শিখার মতো রাগটা দপদপ করে জ্বলছিলো। চিএার হাসিটা যেনো সেই রাগটাকে আরো দ্বিগুন হারে উস্কাচ্ছিলো। জেদ এবং রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমি চোয়াল শক্ত করে চিএার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বললাম,,

“বহুদিন যাবত তোর এসব হেয়ালীপূর্ণ কথা বার্তা সহ্য করে আসছি আমি। খোলসা করে তো কিছু বলছিস ই না, উল্টে নিজের মৃত্যু কামনা করার মতোন দুঃসাহস দেখাচ্ছিস। বুঝিস না তুই না? লেবু বেশি চিপলে তেঁতো হয়ে যায়? আমি ও তেঁতো হয়ে উঠছি?”

চিএা গালে হাত দিয়ে আচমকা ঠোঁট উল্টে কেঁদে বলল,,

“তেঁতো হয়ে গেছি আমি তাই না? বিয়ের ১ মাস পাড় হতে না হতেই তুই আমার উপর তিক্ত হয়ে উঠেছিস? এতোটাই তিক্ত হয়ে উঠেছিস যে, আমার গাঁয়ে ও হাত তুলতে দ্বিধাবোধ করলি না? তোরা পুরুষ জাতরা সব এক। কখনো মেয়েদের ভেতরটা বুঝার চেষ্টা করিস না! তাদের ক্ষত, বিক্ষত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে খুব ভালোই জানিস!”

আমাকে পাশ কাটিয়ে চিএা দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। পিছু ঘুড়ে হতবাক হয়ে আমি চিএার যাওয়ার পথে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। কেনো জানি না একবার ও মনে হলো না চিএাকে আটকাতে। অভিমানের মেঘে সিক্ততা বাড়ল নাকি চিএার হেয়ালীপূর্ণ কথা বার্তায় দম আটকে আসছিলো, সঠিক কারণটাই ধরতে পারছি না আমি। চিএাকে ইদানিং খুব রহস্যময়ী মনে হচ্ছে৷ পুরুষ জাতির উপর হঠাৎ করেই চিএার এতোটা রাগ জন্মালো কিভাবে? আমি কি মনের অজান্তে কোনোভাবে চিএাকে আঘাত করেছি? আমার কোনো কার্যকলাপে চিএা কষ্ট পেয়েছে? নাকি আমার বাইরে ও অন্য কোনো পুরুষ আছে? যার প্রতি চিএার এতো ক্ষোভ? পূর্বের চিএা এবং এখনকার চিএার মধ্যে আকাশ কুসুম তফাৎ আমি লক্ষ্য করতে পারছি। শুধু লক্ষ্য করলেই মনে হচ্ছে হবে না, লক্ষ্য অনুযায়ী আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। একাডেমী থেকে আমার লক্ষ্য যাএা শুরু করতে হবে। চিএাকে ফলো করতে হবে!

,
,

বিকেল ৪ টা। বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান ছেড়ে আমি চিএার রুমের দরজায় কড়া নাড়ছি অনবরত। ভীষণ রেগে চিএা রুমের দরজায় খিল আটকে বসে আছে। কাকু আমাদের বাড়িতে গেছেন পূজো পাঠ করতে। শর্মিষ্ঠার বিয়ের পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করবেন কাকু নিজেই। বিয়ে পড়ানো শুরু হবে রাত ৮ টা থেকে। বিয়ের পূর্বে বাড়িতে পূজো পাঠ করানো আমাদের বংশের অন্যতম রেওয়াজ। কাকুর অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আমি চিএার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। হাজার কাকুতি প্রকাশ করে ও আমি চিএার রুমের দরজা খুলাতে সক্ষম হচ্ছি না। এক রত্তি ও রাগ পড়ছে না চিএার। ক্লান্ত কন্ঠে আমি অবশেষে ঈষৎ চেঁচিয়ে বললাম,,

“ওকে ফাইন। দরজা খুলতে হবে না তোর। রাগ ও বিসর্জন দিতে হবে না। কাশিয়ানী ফিরে যাচ্ছি আমি। আর হয়তো কখনো দেখা হবে না।”

মুহূর্তের মধ্যে ধপধপ পা ফেলে চিএা তেজর্শিনী ভাব নিয়ে রুমের দরজা খুলে আমার সম্মুখস্থ হলো। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আমি ম্লান হেসে বললাম,,

“আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না, তাই তো?”

কাঠিন্য ভাব নিয়ে চিএা হাত বাড়িয়ে আমার দু গালে ঠাস ঠাস করে অনবরত চড় মারছে আর বলছে,,

“একদম থামাবি না আমাকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি। যতোক্ষণ না আমার রাগ শান্ত হবে, ততক্ষন অব্দি এই চড়ের আঘাত গুলো তোকে দাঁত চেঁপে সহ্য করতে হবে।”

মৃদ্যু হেসে আমি চিএার দিকে চেয়ে আছি। চড়ের উর্ধ্বগতি বাড়ছে চিএার। রাগটা ও একটু করে কমে আসছে। রাগান্বিত চোখ জোড়া শান্ত হতেই চিএা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে হাত দুটো সংযত করে নিলো। গাল দুটো অসম্ভব জ্বালা করা সত্ত্বে ও আমি মৃদ্যু হেসে চিএার ক্লান্ত দুচোখে দৃষ্টি স্থির করে বললাম,,

“এটুকুতেই হাফিয়ে গেলি? আমি তো ভেবেছিলাম, আরো ১০০ চড় খেতে হবে হয়তো।”

খনিকের মধ্যে ফুঁফিয়ে কেঁদে চিএা আমাকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে বলল,,

“আমার ভাগ্যটা এতো নির্মম কেনো আরাধ্য? অমৃত সুখ পেয়ে ও কি আমি হারিয়ে বসব? এতো সুখ ছেড়ে যে আমার যেতে ইচ্ছে করবে না আরাধ্য। তবে শর্ত আছে! তুই ও যদি আমার সাথে যাস, নির্বিঘ্নে আমি ও যেতে রাজি। যাবি তো তুই আমার সাথে?”

অল্প সময় নীরব থেকে আমি পরক্ষণে শান্ত কন্ঠে চিএাকে বুঝিয়ে বললাম,,

“কেনো এতো হেয়ালী করিস চিএা? কি হয়েছে তোর বল না? নিরঞ্জন দা তোকে উত্ত্যক্ত করছে? অথবা বাবার ভয় থেকে তুই অযথা অনর্থের কথা বেশি ভাবছিস? যাই হয়ে থাক, প্লিজ আমাকে সব খুলে বল। আমার থেকে অন্তত কিছু আড়াল করিস না প্লিজ!”

চিএা কান্না থামিয়ে হেচকি তুলে বলল,,

“কিছু হয় নি রে৷ সত্যি কিছু হয় নি। তোর বুকে মাথা রেখে একটু ঘুমুতে চাই। ব্যাস, আর কিছুই না!”

চিএাকে পাজাকোলে তুলে আমি বিছানায় শুইয়ে দিলাম। আমি ও চিএার পাশে শুয়ে চিএাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম। আমার বুকে মাথা রেখে চিএা চোখ জোড়া বুজে শান্ত কন্ঠে বলল,,

“কাশিয়ানী কবে নিয়ে যাবি আমায়?”

“তুই রাজি থাকলে আজই!”

“আজ না। তুই একটু স্যাটেল হয়ে নে এরপর!”

“তোর ইচ্ছে। তুই যা বলবি।”

“এর পূর্বেই যদি জেঠু সব জেনে যান?”

“তাহলে আরো ভালো। গোপনে তোকে নিয়ে কাশিয়ানী ফিরতে হবে না আমার। সবার প্রকাশ্যে পর্যাপ্ত অধিকার নিয়ে ফিরতে পারব।”

অল্প সময় মৌন থেকে চিএা আচমকা প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে আমাকে বলল,,

“আচ্ছা? তুই যদি হঠাৎ করেই শুনতে পাস তুই বাবা হতে চলেছিস, পুরুষশাসিত সমাজের মতো তুই ও আমার চরিএে কলঙ্কের দাগ লাগাবি না তো? মেনে নিবি তো আমার গর্ভের সন্তানটাকে?”

চিএাকে বুকের পাজর থেকে উঠিয়ে আমি অগ্নি রূপ ধারন করে চিএার অস্থির দু চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“তোর গর্ভে তো আমার সন্তানই আসবে চিএা। অযথা আমি তোর চরিএে কলঙ্কের দাগ লাগাবো কেনো? কেনো ই বা আমার সন্তানকে আমি মেনে নিবো না? কি বলতে চাইছিস তুই বল তো?”

ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে চিএা আমার ঠোঁটে স্লাইড করে ম্লান হেসে বলল,,

“আমি জানি, আমাকে পুরো দুনিয়া ভুল বুঝলে ও তুই অন্তত আমাকে ভুল বুঝবি না। সব কলঙ্ক উপেক্ষা করে ও তুই আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিবি! সেই বিশ্বাস আছে বলেই তো সমাজে অনেক চিএারা এখনো বেঁচে আছে! মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারছে।”

চিএার প্রতিটা সংলাপে আমি গভীর কোনো রহস্যের টের পাচ্ছি। এবার আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিন্ত হলাম, সাংঘাতিক কিছু একটা ক্রমাগতই ঘটে চলছে আমার অগোচড়ে। যার ভেদ আমার নিজেকেই করতে হবে। চিএা কিছুতেই মুখ ফুটে কিছু স্বীকার করবে না। প্রসঙ্গ পাল্টে আমি তীক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিগ্যাসু কন্ঠে চিএাকে বললাম,,

“আজ একাডেমী যাবি না তুই?”

চিএা মুহূর্তের মধ্যে চোখে, মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে বলল,,

“শরীর দিচ্ছে না আজ। আর কতো বল?”

“শরীর দিচ্ছে না মানে? অসুস্থ তুই?”

চিএা আমাকে পুনরায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,,

“কোথায় অসুস্থ? স্বয়ং ঔষধ তো আমার বুকের সাথেই মিশে আছে। তোকে ছেড়ে আসলে কোথাও যেতে ইচ্ছে না করছে না আরাধ্য। এই বেলাটা তোর সাথেই কাটাতে চাইছি, খুব একান্তভাবে।”

তটস্থ কন্ঠে আমি চিএাকে বললাম,,

“তোকে আমার মোটে ও স্বাভাবিক লাগছে না চিএা। তুই সাংঘাতিক কিছু একটা গোপন করছিস আমার থেকে। দয়া করে বল, তোর কি হয়েছে?”

চিএা অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল,,

“দু দিন পর তো তুই চলেই যাবি আরাধ্য। কেনো অযথা টেনশান করে এই মধুময় সময় গুলো নষ্ট করছিস বল তো? তুই না খুব আনরোমান্টিক টাইপ বুঝেছিস? বউকে আদর করতে জানিস ই না!”

রাগান্বিত ভাব বজায় রেখে আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,,

“এখন আদরের সময় না চিএা। একাডেমী যাবো আমি৷ তুই আমার থেকে কি গোপন করছিস, সব আজ আমি উদ্ধার করেই ছাড়ব।”

হন্তদন্ত হয়ে আমি চিএাকে ছেড়ে উঠতেই চিএা আমাকে হেচকা টান দিয়ে জোরালো ভাবে আমাকে আঁকড়ে ধরে সম্মোহিত কন্ঠে বলল,,

“আই নিড ইউ আরাধ্য। প্লিজ এই অবস্থায় আমাকে ছেড়ে যাস না!”

আমি উগ্র ভাব নিয়ে বিপুল ধস্তাধস্তি করে বললাম,,

“ছাড় বলছি৷ কোনো ভাবেই আজ তুই আমাকে আটকাতে পারবি না চিএা। না বলা অনেক রহস্য তোর মধ্যে বিদ্যমান। যার ভেদ আমাকেই করতে হবে!”

চিএা শরীরের সমস্ত জোর প্রয়োগ করে আমাকে আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায়, পরিশেষে আমার ঠোঁট জোড়া দখল করে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,

“ছাড়ছি না তোকে আমি। আমার এই মুহূর্তে তোকে চাই ই চাই, এট এ্যানি কস্ট!”

আচমকাই উত্তেজনা চেঁপে বসল আমার সর্বাঙ্গে। চেয়ে ও আমি চিএার কামনাকে এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। চিএার চে অত্যধিক কামনায় যুক্ত হয়ে পড়লাম আমি। স্বামীদের রাগ কন্ট্রোল করার এই যাদুটা হয়তো সব স্ত্রীদের মধ্যেই বিদ্যমান আছে। যা আমি এই মুহূর্তে এসে টের পাচ্ছি। কখন চিএাকে নিজের করে নিবো সেই নেশায় আমি ও মত্ত হয়ে পড়লাম!

সন্ধ্যা নামার কাছাকাছি সময়টাতে ঘুমন্ত চিএার নিষ্পাপ মুখটায় অনবরত চুমো খেয়ে আমি শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালাম। চিএার বুকের মাঝখানটায় ভয়াল নখের আঁচড় গুলো এখনো স্পষ্টত। জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিলো এই অবাঞ্ছিত আঁচড় গুলো আমার শরীরে। কিছুতেই মানতে পারছি না, মশা তাড়ানোর ফল এটা৷ মস্তিষ্কে নানা ধরনের প্রশ্নের দলা পাঁকিয়ে আমি চিএার রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে হম্বিতম্বি হয়ে একাডেমীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যে করেই হোক, আজ আমার জানতেই হবে একাডেমীতে আমার অগোচড়ে কি হচ্ছে বা কি চলছে!

প্রায় আধ ঘন্টা পায়ে হেঁটে আমি একাডেমীর মেইন গেইটে হাজির হলাম। বিশাল বড় নীল রঙ্গের গেইটটা ভেতর থেকে তালা বন্দী। বাউন্ডারি দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরে ও জন প্রানীর কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না আমি। প্রতিদিন তো এই সময়টাতেই খুব কোলাহলপূর্ণ থাকে সম্পূর্ণ একাডেমী প্রাঙ্গন। তবে আজ কেনো একাডেমী এতোটা শুনশান? কোনো বিশেষ কারণে একাডেমী বন্ধ আছে নাকি অন্য এর পিছনে ও অন্য কোনো রহস্য আছে?

কৌতুহল নিয়ে আমি বাউন্ডারির পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতেই একাডেমীর প্রফেসর “শুকলা সেনের” বিশাল বাড়িটা চোখে পড়ল আমার। দু তলার ব্যালকনীতে খুব আয়েস করে পায়ের উপর পা তুলে বসে স্যার অনবরত চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। পাশে অবশ্য তিন জন মাঝবয়সী লোক ও আছেন। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খোশ গল্প করছেন এবং উচ্চ শব্দে হাসাহাসি করছেন। দূর থেকে ও আমি সবটা উপলব্ধি করতে পারছি। উনাদের দেখে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করে আমি বাউন্ডারির ঐ প্রান্ত থেকে স্যারকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বললাম,,

“শুকলা স্যাস্যাস্যার। শুনছেছেছেন?”

ক্রমান্বয়ে ১০ থেকে ১২ বার ডাকাডাকির পর শুকলা স্যার বাউন্ডারীর পশ্চিম প্রান্তে দৃষ্টি নিবদ্ধন করলেন। চোখে, মুখে অস্থিরতার ছাপ ফুটিয়ে উনি হাত নেড়ে ইশারা করে বললেন, “পরে আসতে।” বিষয়টা দারুন সন্দেহের ঠেকতেই আমি সন্দিহান কন্ঠে পেছনের চুল গুলো টেনে বিড়বিড় করে বললাম,,

“স্যার তো কখনো আমার সাথে কথা বলা বা দেখা করার জন্য এতোটা গাঁ ছাড়া ভাব দেখান নি, তবে আজ কেনো আমাকে দেখা মাএই উনি এতোটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন? এর পিছনে কি কোনো বিশেষ কারণ আছে নাকি আমিই অযথা বেশি ভাবছি? কোনটা?”

ইতোমধ্যেই পেছন থেকে একজন অপরিচিত পুরুষালী কন্ঠস্বর আমার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো। কৌতুহল নিয়ে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই ঝাপসা আলোতে একজন লম্বা, চূড়া, সুঠাম দেহধারী, সুদর্শন যুবককে দৃষ্টিলোকন করলাম। জিগ্যাসু দৃষ্টিতে উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে গলা খাঁকিয়ে বললেন,,

“চিএা দাস নামের কোনো মাঝ বয়সী মেয়েকে আপনি চিনেন?”

চোখে, মুখে অপার আশ্চর্যিত ভাব ভর করল আমার। কৌতুহল যেনো আকাশ ছুঁয়ে নিচ্ছিলো। পর পর অনেক গুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করল। কপাল কুঁচকে আমি যুবকটিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“চিএা দাসকে দিয়ে আপনি কি করবেন? কি কাজ উনার সাথে আপনার?”

যুবকটি ভীষণ তৎপর হয়ে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,,

“আসলে, চিএা দাসের সাথে এই মুহূর্তে দেখা করাটা এবং সামনাসামনি বসে কথা বলাটা আমার ভীষণ জরুরি। কাইন্ডলি উনার বাড়ির ঠিকানাটা বা উনার পরিচয়টা দিতে পারবেন?”

ভ্রু যুগল খড়তড় ভাবে কুঁচকে আমি প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“আগে বলুন কে আপনি? চিএার সাথে কি এমন জরুরি প্রয়োজন আপনার?”

যুবকটি ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,

“আমার পরিচয় দেওয়াটা কি খুব বেশি জরুরি?”

আমি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললাম,,

“অতি জরুরী। ভনিতা না করে পরিচয়টা দিন।”

“আমার পরিচয়টা দেওয়ার পর আপনি চিএা দাসের পরিচয়টা দিবেন তো? কথা দিতে হবে কিন্তু আপনাকে!”

আমি ক্ষুব্ধ হয়ে অধৈর্য্য কন্ঠে বললাম,,

“অদ্ভুত লোক তো আপনি। কার পাড়ায় এসেছেন আপনি জানেন? আর কার সাথে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলছেন আপনি জানেন? পাল্টা শর্ত দেওয়ার অপরাধে আপনার কি অবস্থা করতে পারি আমি, ধারণা আছে আপনার?”

যুবকটি ম্লান হেসে মিহি কন্ঠে বলল,,

“আপনাকে দেখতে অতোটা ও অবিচক্ষণ মনে হচ্ছে না আমার। যথেষ্ট বিচক্ষণ আপনি। অন্তত অপরিচিত লোকজনদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, সম্মান দিতে হয় সবটাই জানেন আপনি। আমি যতোটা আঁচ করতে পারছি, চিএা দাস আপনার অতি পরিচিত কোনো ব্যক্তি। তাই হয়তো আপনি এতোটা রিয়েক্ট করছেন!”

আমি সোজা সাপ্টা কন্ঠে বললাম,,

“এক কথায় উত্তর চাইছি আমি। আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? আর চিএার পরিচয় দিয়েই বা আপনি কি করবেন?”

যুবকটি অপারগ কন্ঠে বলল,,

“মনে হচ্ছে এইবার পরিচয়টা আপনাকে দিতেই হবে।”

একবার দম নিয়ে যুবকটি পুনরায় বলল,,

“আসলে আমি চিএা দাসের বন্ধু “মৃনালীর খুড়তুতো ভাই।” মৃনালীর সুসাইডের ব্যাপারে চিএা দাসের সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো। একাডেমীর সামনে প্রায় ১ সপ্তাহ যাবত আমি ঘুরাঘুরি করছি তবে একাডেমীর অভ্যন্তরীণ কেউ চিএা দাসের পরিচয় আমাকে দিচ্ছেন না! চিএা দাসের মুখের আদল না চেনার দরুন আমি সারাক্ষণ একাডেমীর সামনে ঘুড়ে ও চিএা দাসকে চিহ্নিত করতে পারছি না।”

 

পর্ব সমাপ্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button