ধারাবাহিক গল্প

শ্রাবণ আঁধারে পর্ব ৮, ৯

কলমে নিশাত জাহান নিশি

 

“দেখলি তো? মিথ্যে কোনো অন্যায়ের দায় আমার উপর বর্তায় নি। আমি যা করি নি, তার জন্য আমাকে লড়তে হবে না!”

চিএার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি অগ্রে দন্ডায়মান অফিসার গুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তাদের দৃষ্টিতে নেতিবাচকতার ছড়াছড়ি স্পষ্ট টের পাচ্ছি আমি। গোঁফ, দাঁড়িওয়ালা গম্ভীর স্বভাবের পুলিশ অফিসারটা আচমকা ঘূর্ণায়মান লাঠিটা স্থগিত করে সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে চিএাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“ছেলেটা কে মিস চিএা? আপনার রুমে কি করছেন উনি?”

চিএা শুকনো মুখে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি ফট করে চিএার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গলা ঝাঁকিয়ে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠেই বললাম,,

“আমার পরিচয় জেনে আপনার কি হবে? ভুল ভ্রান্তি যেহেতু মিটেই গেছে, সেহেতু আপনারা যেতে পারেন। আমার অন্তত মনে হচ্ছে না, আপনাদের এখানে থেকে আর কোনো বাড়তি কাজ আছে!”

তীব্র অপমানিত বোধ করে অফিসারটা আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চিএার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“যা বলেছি তার সোজাসুজি উত্তর দিন মিস চিএা! এই ছেলেটা কি হয় আপনার?”

চিএা কাঠ কাঠ গলায় কিছু বলার পূর্বেই কাকু পাশে দাঁড়িয়ে ম্লান কন্ঠে বললেন,,

“চিএার বন্ধু হয়। আমাদের পাড়ার জমিদার, “নির্মলেন্দু সেনগুপ্তের” ছেলে! আরাধ্য সেনগুপ্ত।”

কটমট দৃষ্টিতে অফিসার একবার আমার দিকে চেয়ে হম্বিতম্বি হয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। অফিসারদের যাওয়ার পথে চেয়ে কাকু স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন,,

“ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন আমাদের। আর একটুর জন্য আমার নির্দোষ মেয়েটা হয়তো সত্যি সত্যিই ফেঁসে যেতো!”

চিএা মৃদ্যু হেসে কাকুর পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,,

“আমি বলেছিলাম না বাবা? আমি নির্দোষ! তোমার মেয়ে জেনে শুনে কোনো পাপ কাজ করতেই পারে না!”

কাকু ম্লান হেসে চিএাকে বুকে জড়িয়ে বললেন,,

“আমি তো আমার মেয়েকে এমন শিক্ষা দেই নি মা। যে শিক্ষার প্রভাবে আমার মেয়ের স্বভাব, চরিএে কিঞ্চিৎ পরিমান পাপাচারের ছিটি ফোঁটা লাগে। আমার মেয়ে তো পবিএের আঁধার। স্বয়ং দেবী প্রতিমা।”

চিএা ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে কাকুর বুকের পাজর থেকে মাথা তুলে চোখে ভাসমান জলরাশি গুলো মুছে বিরামহীন কন্ঠে বলল,,

“যাও বাবা, পূজোর সময় হয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে তো আজ তোমার পূজো আছে তাই না? উনারা হয়তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কতো রাত হয়ে গেলো বলো তো?”

কাকু হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়িয়ে পিছু ঘুড়ে আমার দিকে চেয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“কিছুসময় থেকে যাও আরাধ্য। রাতের খাবার খেয়ে এরপর বাড়ি ফিরবে! কেমন?”

আমি জোর পূর্বক হাসি টেনে হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়ালাম। কাকু দ্রুত পায়ে হেঁটে প্রস্থান নিলেন। আমি হম্বিতম্বি হয়ে চিএার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে চিএাকে বললাম,,

“অফিসারটা আমার সাথে এমন রুড বিহেভ করলেন কেনো? আর তুই ই বা অফিসারটাকে এতোটা ভয় পাচ্ছিলে কেনো? কি কারণ আছে বল?”

চিএা কপাল কুঁচকে বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,,

“উফফফ কি কারণ থাকবে? কি যা তা বকছিস তুই?”

আমি সন্দিহান কন্ঠে বললাম,,

“আমার কেনো জানি না, তোর ভাবভঙ্গি এবং সেই পুলিশ অফিসারের ভাব ভঙ্গি দেখে খুব সন্দেহের ঠেকছে। কি লুকাচ্ছিস তোরা বল তো?”

চিএা ভড়কে উঠে অস্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল,,

“একটু বেশিই ভাবছিস তুই। সন্দেহের পরিমানটা দয়া করে একটু হ্রাস কর আরাধ্য। বিশ্বাস কর, তোর থেকে কিছু লুকানোর নেই আমার!”

আমি দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বললাম,,

“সত্যি তো?”

চিএা আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা নিচু করে বলল,,

“হুম সত্যি।”

স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আমি চিএার দু কাঁধে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললাম,,

“তোকে আমি বিশ্বাস করি চিএা। এই ভবে, মায়ের পরে তোকেই আমি বিশ্বাস করি। সেই পবিএ বিশ্বাসের জায়গায় সন্দেহের কোনো ঠাঁয় নেই।”

চিএা মাথা তুলে আমার দিকে চেয়ে মৃদ্যু হাসল। চিএার হাসিমাখা মুখে এক ধ্যানে তাকিয়ে আমি অদ্ভুত এক ঘোরে ডুবে বললাম,,

“এভাবে হাসিস না চিএা। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় আমার৷ তুই হয়তো জানিস না, তোর থেকে দূরে গেলেই নিশ্বাসের ব্যামো হয় আমার। তখন কি মনে হয় জানিস? সেই করুন অবস্থাটায় তোর এই হাসিমাখা মুখটা দেখলে হয়তো নিশ্বাসের ব্যামোটা সেরে গেলে ও যেতে পারে! থাকবি তো সবসময় আমার এতোটা কাছে? এখন যতোটা কাছে দাঁড়িয়ে আছিস? খুব ক্ষতি হয়ে যাবে কি? যদি আমার এই আর্জিটা রাখিস?”

চিএা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে হুট করে আমার বুকে মিহিভাবে কপাল ঠেঁকিয়ে বলল,,

“ক্ষতি হবে না নিশ্চয়ই। জানিস আরাধ্য? তোর সাথে ঘর বাঁধার প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার! কিছুটা অসুখ ও বটে। বউ তো বানিয়ে নিলি আরাধ্য। একটা ঘর বানাতে পারবি না বল?”

আমি খুশিতে আত্নহারা হয়ে বললাম,,

“জাস্ট কয়েকটা মাস সময় দে আমায়। খুব দ্রুত আমি তোকে স্ব-সম্মানে আমার ঘরে তুলব। বাবা, মা, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন কারো তোয়াক্কা করব না আমি। চিএাকে আপন করে নিতে আমার আশেপাশের অবাঞ্ছিত লোকজনদের প্রয়োজন নেই একদমই। মুখ্য ব্যক্তিটা পাশে থাকলেই হবে!”

চিএা অতি আদুরে ভঙ্গিতে শক্ত করে আমাকে ঝাপটে ধরে স্বস্তির একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,,

“ভালোবাসি আরাধ্য। ভীষণ ভালোবাসি। নিজেকে তোর বউ ভাবতেই বুকের ভেতরে কেমন যেনো অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে। তোকে বুঝতে পারব না সেই ভালো লাগার অনুভূতিগুলো। বুকের গোঁটা একটা অপূর্ণ অংশ পূর্ণতায় ভরে যাচ্ছে বিশ্বাস কর।”

চোখ জোড়া বুজে আমি চিএাকে শক্ত করে ঝাঁপটে ধরে প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে বললাম,,

“ভেবেছিলাম এই জন্মে তোকে আমার ভালোবাসার আকুতি গুলো বুঝানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারব না৷ তুই ও হয়তো মন থেকে আমার ভালোবাসার অনুভূতি গুলো বুঝতে সক্ষম হবি না। এভাবেই বুঝা না বুঝার সংমিশ্রনে গোটা জনম পাড় হয়ে যাবে। বুকের ভেতর অদৃশ্য যন্ত্রণাটা বৃদ্ধি পেতে পেতে দ্বিগুন হবে। তোর মুখোমুখি হলে সমস্ত না বলা অনুভূতি গুলো থমকে দাঁড়াবে। গলা জড়িয়ে আসবে, জিভ শুকিয়ে আসবে, ভেতরটা হু হু শব্দে কেঁদে উঠবে! অনুভূতিরা ও সাহসের অভাবে পালাবে। তোকে চেয়ে চেয়ে ই হয়তো অশান্ত, উত্তেজিত মনকে শান্ত করতে প্রতিনিয়ত দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগতে হবে। হাত বাড়িয়ে তোকে ছোঁয়ার
উপায়টা ও তখন দিশেহারা হয়ে দাঁড়াবে। মনের সঠিক যত্নের অভাবে অভিমান জমতে জমতে তিক্ততা বাড়বে। এক সময় হয়তো তোকে ছোঁয়ার প্রখর ইচ্ছেটা ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে! চোখ তার নিদ্রা ভুলে মস্তিষ্কের দুরারোগ্য ব্যামো হয়ে দাঁড়াবে। শূণ্য মস্তিষ্কে তোর অবহেলা শুধু শোভা পাবে। এসব অনর্থ হওয়ার আগে, অবশেষে ঈশ্বর তোকে সমস্তটা বুঝার সুবুদ্ধি দিয়েছেন। বিশ্বাস কর, খুব ঋণী আমি ঈশ্বরের কাছে। খুশিতে এই মুহূর্তে আমি হাসতে ও ভুলে যাচ্ছি। শরীরটা উত্তেজনায় এতোটাই কাঁপছে যে, একই জায়গায় স্থগিত থাকতে পারছি না আমি। আর একটুখানি শক্ত করে আলিঙ্গন করবি আমায়?”

শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে চিএা আমাকে ঝাঁপটে ধরে গলা জড়ানো স্বরে বলল,,

“কখনো কেঁদেছিস আমার জন্য? কখনো আমার বিরহে চোখ থেকে অন্তত এক ফোঁটা জলের আবির্ভাব টের পেয়েছিলি? আমাকে পাবি না ভেবে, রাতের পর রাত চোখের জলে নিজেকে ভাসিয়েছিলি? প্রভাতে ঘুম থেকে জেগে কখনো বুকের ভেতরটায় এক খাঁ খাঁ শূণ্যতা অনুভব করেছিলি? বুকে হাত দিয়ে তখন চোখের কোণে অবাধ্য জলদের ছুটোছুটি টের পেয়েছিলি? কল্পনায় তোর কাছাকাছি আমাকে সাজাতে সাজাতে হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এসে তোর আশেপাশে আমাকে দেখতে না পাওয়ার কষ্টে কখনো অশ্রুবিলাস করেছিলি? ঝুম বৃষ্টিতে চোখের জলের সাথে বৃষ্টির জল মিশিয়ে নিজেকে অশ্রুসিক্ত করেছিলি? রাতের সহস্র তাঁরার পানে চেয়ে আকাশের সব’চে উজ্জ্বল তাঁরাটাকে আমি ভেবে হাসিমুখে ও অশ্রুসিক্ত চোখে আমার অনুভূতি টের পেয়েছিলি?”

“না। এসবের কিছুই হয় নি কখনো। হৃদয় কাঁদলে ও আমার চোখ জোড়া কখনো কাঁদে নি। আমি অতি সহজে কাঁদতে পারি না চিএা। হয়তো কাঁদতেই পারি না। তার মানে এই না যে, আমার হৃদয় ভাঙ্গে না। প্রতিনিয়ত আমার হৃদয় ভাঙ্গে, হৃদয় কাঁদে, হৃদয় পুঁড়ে। উপরিভাগে তার প্রভাব নাই পড়তে পারে। বিরহের বহিঃপ্রকাশ যদি কেবলিমাএ চোখের জলেই হয়ে থাকে, তবে ঈশ্বর কেনো ছেলেদের এই বহিঃপ্রকাশের ক্ষমতাটা দিয়ে সৃষ্টি করেন নি? অভিযোগ তো ঈশ্বরের উপর থাকা উচিত তাই না?”

চিএা চোখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,,

“যেদিন তুই আমার জন্য চোখ ভাসিয়ে কাঁদতে পারবি, সেদিন আমি বুঝে নিবো তুই আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসিস। মরে ও তখন শান্তি পাবো আমি। ভালোবাসা চেনার উপায় তো, শুধুমাএ “চোখের জল।” কারণ, ছেলে মানুষ কখনো অভিনয় করে ও কাঁদতে জানে না। তারা কাঁদলে মন থেকেই কাঁদে। তোকে ও একদিন আমার জন্য মন থেকে কাঁদতে হবে আরাধ্য। আর সেদিনই আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে!”

অবুঝ দৃষ্টিতে আমি চিএার দিকে চেয়ে আছি। এবার নাকি আমাকে চোখ ভাসিয়ে ও কাঁদতে হবে! হৃদয় ভাসিয়ে যে এতো গুলো বছর কেঁদে আসলাম, তার কোনো মূল্য নেই? যাই হোক, মনে হচ্ছে এবার থেকে কান্নার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। রাত, দিন অনুশীলন করতে হবে কিভাবে কাঁদতে হয়! এই মেয়ে আমাকে দেবদাস বানিয়ে ছাঁড়বে! কান্নার মতোন দুঃসাধ্য কাজটা ও আমাকে দিয়ে সাধন করে অতঃপর শান্ত হবে। কি আর করার? অর্ধাঙ্গিনীর মন তো জয় করতেই হবে!

মৌণতা ভেঙ্গে চিএা আচমকা লজ্জা রাঙ্গা হাসি হেসে আমার দু চোখে তার দৃষ্টি স্থির করে বলল,,

“আমি স্ত্রীর অধিকার চাই আরাধ্য। দিবি আমাকে সেই অধিকার?”

আশ্চর্যিত মুখমন্ডলে আমি মুখটা হা করে চিএার পানে তাকাতেই চিএা হঠাৎ চোখে, মুখে কেমন যেনো এক উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটিয়ে বলল,,

“আমি সর্বপ্রথম তোর হতে চাই আরাধ্য! তুই ই তো আমার সব বল?”

ভ্রু যুগল সংকুচিত করে আমি সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে চিএার দিকে চেয়ে বললাম,,

“সর্বপ্রথমে আমার হতে চাস মানে? তুই তো সর্বপ্রথমে ও আমার, সর্বশেষে ও আমার।”

চিএা খানিক থতমত খেয়ে বলল,,

“আরে কিছু না। উত্তেজনায় কি থেকে কি বলে বসেছি। আমার সব কথায় তোর এতো আগ্রহ দেখাতে হবে কেনো শুনি? সব কথা কানে নেওয়া কি ভীষণ জরুরি?”

“তোর প্রতিটা কথা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ চিএা৷ এতো গুলো বছরে ও বুঝতে পারিস নি না?”

সম্মোহিত দৃষ্টিতে চিএা আমার পানে চেয়ে আচমকা আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে এসে বলল,,

“তাহলে, এই মুহূর্তে আমাকে আপন করে নেওয়াটা ও তোর কাছে ভীষণ জরুরি! প্লিজ আমাকে আপন করে নে!”

ঘোর লেগে আসছিলো আমার চিএার সম্মোহনী ভাব দেখে। মিলনের আমন্ত্রণে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি। চেয়ে ও নিজেকে আটকে রাখতে পারছিলাম না। চিএার ডাকে আমার সাড়া দিতেই হলো। চিএার পূর্বেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আমি চোখ জোড়া বুজে মুহূর্তের মধ্যে চিএার ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলাম। চিএা মৃদ্যু হেসে আমার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরতেই আমি চিএাকে পাজা কোলে তুলে বিছানায় চিএাকে শুইয়ে দিলাম। দরজার খিল আটকে আমি অধিক উত্তেজিত হয়ে চিএার গাঁয়ের উপর নিজেকে সমর্পণ করলাম। চিএা নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি বাঁকা হেসে চিএার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলাম। উত্তেজনায় খানিক কেঁপে চিএা কম্পিত কন্ঠে বলল,,

“বাবা হয়তো ঘন্টা খানিকের মধ্যে ফিরে আসবেন আরাধ্য। বুঝতে পারছিস তো? তোর সময় ঠিক কতোটা?”

আমি ঘোরজড়ানো কন্ঠে বললাম,,

“হুম৷ তাছাড়া আমি ভাবছি, আমাদের বিয়ের বিষয়টা কাকুকে অবগত করে রাখব। এতে হয়তো দুজনই নিশ্চিন্ত হতে পারব। তোর বিয়ের জন্য ও কাকু ছেলে খুঁজবেন না। আর আমার মাথা থেকে ও আলাদা একটা দুশ্চিন্তা দূর হবে।”

“বাবা যদি মেনে না নেন? অতি ক্ষুব্ধ হয়ে জেঠুকে সবটা বলে দেন, তখন কি হবে?”

“যা হওয়ার হবে। বাবা যতো কিছুই করুক, আগামী সাত জন্মে ও তোর থেকে আমাকে আলাদা করতে পারবেন না চিএা। চিএা শুধু আরাধ্যের, শুধুমাএ আরাধ্যের!”

চিএার ঘাঁড়ের দিকটায় হালকা বাইট বসাতেই চিএা ভীষণ কেঁপে আমাকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে চোখ জোড়া বুজে বলল,,

“তুই কি একটু পরেই বাড়ি ফিরে যাবি আরাধ্য?”

“উহু। কাশিয়ানী ফিরব। বাবার মুখোমুখি হতে আমার রুচিতে বাঁধে বিশ্বাস কর!”

চিএা চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,,

“মানে? এতো রাতে তুই কাশিয়ানী ফিরবি?”

“হুম, তো? এক সপ্তাহ পরে তো আবার গ্রামে ফিরছি। শর্মিষ্ঠার বিয়ে আগামী সপ্তাহে। এমনিতে ও আসতে হবে।”

“ঠিক আছে। কিন্তু এতো রাতে তুই কাশিয়ানী ফিরে যাবি? রিস্কি হয়ে যাবে না ব্যাপারটা?”

চিএার ঘাঁড় থেকে মুখ উঠিয়ে আমি চিএার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে অস্পষ্ট স্বরে বললাম,,

“কিচ্ছু রিস্ক হবে না। কাল সকাল ৯ টায় ম্যাচ আছে আমার। কিছুতেই মিস করা যাবে না।”

“ঠিক আছে। কিন্তু আজ রাতটা বাড়িতে থেকে, ভোরে রওনা দিলেই আশা করছি তুই সকাল ৯ টার পূর্বে কাশিয়ানী পৌঁছে যেতে পারবি।”

চিএার ঠোঁট জোড়া প্রখর ভাবে আঁকড়ে ধরে আমি রাগান্বিত কন্ঠে বললাম,,

“উফফফ, চুপ কর তো একটু। ডিস্টার্ব হচ্ছে আমার। ”

চিএা মলিন হেসে সত্যিই চুপ হয়ে গেলো। আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকে আঁকড়ে ধরে নিজের দেহ, মন সব আমাতে সোঁপে দিলো। চিএাকে সম্পূর্ন নিজের করে পেয়ে আজ খুশিতে উদ্বেলিত আমি। এতো বছরের অপেক্ষার ফল আমার স্বার্থক হয়েছে। মনের কোণে জমিয়ে রাখা ভালোবাসা গুলো পূর্ণতার ছোঁয়া পেলো!

রাত ১০ টা বাজার কাছাকাছি সময়টাতে চিএাকে ছেড়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। গাঁয়ে কাঁথা পেঁচিয়ে চিএা ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। শার্টটা গাঁয়ে জড়িয়ে আমি চিএার পাশে বসে চিএার কপালে দীর্ঘ এক চুমো খেয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম,,

“আসছি আমি৷ এক সপ্তাহ পর দেখা হচ্ছে।”

চিএা মনমরা কন্ঠে বলল,,

“বাবা বলেছিলেন, একসাথে রাতের খাবার খেয়ে যেতে।”

“লেইট হয়ে যাবে ভীষণ। কাকুকে তুই বুঝিয়ে বলিস।”

কাঁথাটা গাঁয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে চিএা শোয়া থেকে উঠে আমার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ জোড়া বুঝে ছোট আওয়াজে বলল,,

“ছাড়তে ইচ্ছে করছে না তোকে, বিশ্বাস কর!”

চিএার কপালে দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে আমি ম্লান কন্ঠে বললাম,,

“আমারো ইচ্ছে করছে কই? তবে যেতে তো হবেই। ভাবিস না, এক সপ্তাহ পর আবারো ফিরছি আমি। তোর আরাধ্য তোর কাছে ফিরে আসছে।”

চিএা করুন কাকুতি ভরা কন্ঠে বলল,,

“শেষ বারের মতোন একটু জড়িয়ে ধরবি আমায়?”

মৃদ্যু হেসে আমি চিএাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বললাম,,

“শেষ থেকেই শুরু তাই তো?”

চিএা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,

“হুম।”

বুকে পাথর চেঁপে আমি চিএাকে ছেড়ে কাশিয়ানীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাত ১২ টার কাছাকাছি সময়টাতে কাশিয়ানী পৌঁছে আমি প্রথমেই স্নান সেরে নিলাম। আমাকে স্নান করতে দেখে আজহার নানা রঙ্গের ঠাট্টা মশকরা করছে। হাসি দিয়ে আমি ও তার ঠাট্টা মশকরা গুলোকে সায় দিচ্ছি। অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর দুজনই ডিনার সেরে আলাদা দুই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতেই আজ শান্তির একটা ঘুম ধরা দিলো চোখে। মনে হচ্ছিলো এতো বছরের জমানো ঘুম গুলো চোখের পাতায় ভর করে ছিলো। একটা পাকাপোক্ত স্বস্তি পাওয়ার পরই তারা দুচোখে প্রবল ভাবে হানা দিলো। স্বপ্নে ও যেনো চিএার সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহূর্তগুলো চোখে ভাসছিলো আমার। চিএার লজ্জা পাওয়া মুখটা আরো বিশেষভাবে স্বপ্নে আমাকে জ্বালাচ্ছিলো!

________________________________________________

এক সপ্তাহ কেটে গেলো মাঝখানে। আজ শর্মিষ্ঠার গাঁয়ে হলুদ। বাড়ি থেকে দুদিন যাবত লাগাতার কল আসছে। কখন বাড়ি ফিরব, কখন রওনা দিবো, বিয়ে এটেন্ড করব কিনা এই নিয়ে নানা ধরনের কল। তবে বাবার নাম্বার থেকে একটা মিসড কল পর্যন্ত আমার কললিস্টে শো করল না। এই না যে, বিষয়টা নিয়ে আমি ভীষণ আপসেট। বরং এই ভেবে ভালো লাগছে যে, চিএা সম্পর্কিত কোনো কটু কথা আমার শুনতে হচ্ছে না। বাবা কল দেওয়া মানেই হলো, চিএাকে নিয়ে কটু মন্তব্য করা। আমার কানে বিষ ঢুকানোর বন্দোবস্ত করা!

বিকেল ৫ টা নাগাদ ম্যাচ শেষ হতেই আমি হলে ফিরে এসে স্নান সেরে ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রথমে আমাকে নিউ মার্কেট যেতে হবে। ওখান থেকে চিএার জন্য একটা লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, লাল বিন্দি আর আলতা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। অবশ্য ১০১ টা পদ্মফুল ও আছে। গাজরা ফুল ও একটা সাথে নিবো ভাবছি। চিএার খোঁপায় বাঁধব বলে। এই প্রথমবার চিএার জন্য আমি এতো শপিং করব, ভাবতেই প্রবল উত্তেজনা কাজ করছে মনে।

এক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত শপিং শেষ করে আমি ট্রলি ব্যাগটায় শপিং গুলো গুছিয়ে বাঁ হাতে ১০১ একটা পদ্ম ফুল হাতে নিয়ে বাস স্পটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাস্তার প্রতিটা মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে আছে। বিশেষ করে মেয়েদের দল৷ তারা যেনো হা করে আমাকে মুগ্ধিত দৃষ্টিতে দেখছে। অনেকে মুখে মুখে বলাবলি করে বলছে,,

“নিশ্চয়ই ছেলেটার গার্লফ্রেন্ডের জন্য পদ্মফুল গুলো নিয়ে যাচ্ছে। হাউ রোমান্টিক বয়ফ্রেন্ড ইয়ার!”

অনেকে আবার হিংসাত্মক কন্ঠে বলছে,,

“ধ্যাত হিংসে হচ্ছে ভীষণ৷ কোন মেয়ের ভাগ্যে এত্তো রোমান্টিক ছেলে জুটেছে গড নৌজ।”

মৃদ্যু হেসে আমি সবার বাত চিত এক কানে প্রবেশ করিয়ে অন্য কান দিয়ে নির্গত করছিলাম। সর্বশেষে সিঁদুরের কৌটো কিনে আমি গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে বাসে উঠে পড়লাম। হাতে গোনা এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যেই আমি চিএার মুখোমুখি হবো। সেই খুশিতে আমি উন্মাদ না হয়ে যাই! মনে মনে বহু জল্পনা কল্পনা সাজিয়ে আমি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে মগ্ন। ঠোঁটের আলিজ থেকে মৃদ্যু হাসির রেশ যেনো কিছুতেই কাটছে না। আশেপাশের লোকজন আমার এমন অহেতুক হাসি দেখে নিশ্চয়ই মনে মনে আমাকে পাগল ভাবতে ব্যস্ত!

প্রতীক্ষার প্রহর ঘনিয়ে গোপালগঞ্জ এসে পৌঁছলাম মাএ। বাস স্টপ থেকে রিকশা করে আমি চিএাদের বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেলো। চিএার রুমের চৌকাঠে পা রাখতেই কাকুকে দেখলাম বিছানায় শুয়ে খকখক শব্দে কাশতে। উদ্বিগ্ন হয়ে আমি ট্রলি ব্যাগটা নিচে রেখে ফুল গুলো বিছানার উপর রেখে কাকুর পাশে বসে বললাম,,

“কি হয়েছে কাকু? শরীর খারাপ লাগছে?”

কাকু শুকনো কেঁশে কম্পিত কন্ঠে বললেন,,

“এএএকটু জজজল দিবে বাবা?”

“দিচ্ছি কাকু।”

ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমি রান্নাঘর থেকে গ্লাস ভর্তি জল এনে কাকুকে শোয়া থেকে উঠিয়ে কাকুর মুখের কাছে ধরতেই ঢকঢক করে কাকু সম্পূর্ণ জলটা শেষ করে বড় বড় শ্বাস টেনে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“চিএার কাছে এসেছ বাবা?”

“হুম কাকু৷ চিএা কোথায়?”

“চিএা তো এখনো একাডেমী থেকে ফিরে নি বাবা।”

“হোয়াট? সন্ধ্যে ৭ টা বাজছে। চিএা এখনো বাড়ি ফিরে নি? বিকেল ৫ টা বাজেই তো চিএার ক্লাস শেষ হওয়ার কথা!”

“জানি না বাবা৷ ইদানিং মেয়েটার বাড়ি ফিরতে খু্ব বিলম্ব হয়৷ কিছু জিগ্যেস করলেই বলে, ইদানিং বুঝি নাচের অতিরিক্ত ক্লাস বেড়েছে!”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। প্রখর রাগান্বিত ভাব নিয়ে আমি মাথা নত করে কাকুকে বললাম,,

“আমি একাডেমীতে যাচ্ছি কাকু। চিএাকে সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরব।”

ইতোমধ্যেই পেছন থেকে চিএার কন্ঠস্বর ভেসে এলো। উদাস কন্ঠে চিএা পেছন থেকে আমাকে ডেকে বলল,,

“আরাধ্য।”

তড়িঘড়ি করে আমি পিছু ঘুড়ে তাকালাম। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় চিএাকে দেখা মাএই আমার ভেতরটা ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠল। চোখের নিচে স্পষ্টত কালো দাগ, গালের কিছু কিছু অংশে ভ্রুনের দাগ, শুকনো মুখমন্ডল, ফেঁটে যাওয়া ঠোঁট, এলোমেলো চুলে বৈরাগী ভাব। সবটা মিলিয়ে চিএাকে দেখতে বিভৎস লাগছে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমি চিএার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুকনো কন্ঠে বললাম,,

“কি হয়েছে চিএা? তোকে এতো এলোমেলো দেখাচ্ছে কেনো?”

পর্ব সমাপ্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button