গল্প

ফুলবানুর স্বাধীনতা : সবুজ মাহমুদ

তুই যেদিন দুনিয়াতে আসলি তোর বাপের কি যে আনন্দ! সারাদিন রিক্সা চালাইয়া যে কয়টি টাহা হইছিল, সব টাহার মিষ্টি কিনা আইনা সবাই কে খিলাইছে। সখিনা খালা, তোর বাপের নামের সাইরে নাম রাখছে হারুনের মাইয়ার নাম হিরা”।ফুলবানু তার মেয়ের কাছে গল্প করতে করতে আঁচলে দুই চোখ মুছে নিল। এরপর আর কথা না বলে হিরার মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিতে লাগলো। হয়তো সব কথা হিরার কাছে গল্পই মনে হয়েছে তার কারণ বাবার কথা মনে নেই হিরার। যখন হিরার বয়স মাত্র ৩ বছর তখন বাবাকে হারিয়েছে। তাই,বাবার কথা শোনার আগ্রহ নেই। ফুলবানু অন্যের বাড়িতে কাজ করে  সংসার চালায়। দুনিয়াতে  মা আর মেয়ে ছাড়া তাদের আর কেউ নেই। ঝিঁয়ের কাজ করে যে কয়টি টাকা পায় তা চাল, নুন আর থাকার জন্য রাস্তার পাশে কয়েকটি টিন দিয়ে বাঁধানো যে ছাপড়া ঘরে থাকে সেই ঘর ভিটার ভাড়া দিতেই শেষ। অন্যের ব্যবহার করা পুরাতন ছেড়া বসনে নিজেকে যথাসাধ্য ঢেকে রাখে। হিরার সমবয়সী মেয়েদের পুরাতন জামা চেয়ে এনে হিরাকে পরায়,তবে মাঝে মাঝে গজ কাপড় কিনে এনে নিজ হাতে ফোড়াক জামা বানাইয়া দেয়। এখন হিরার বয়স ৯ বছর। এ বয়সে স্কুলে পড়ার কথা, কিন্তু মেয়েকে স্কুলে পড়ানোর  সামর্থ্য ফুলবানুর নেই। দেশ স্বাধীন হলেও তারা আজও পরাধীন।সকল মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। ফুলবানু কখনই ভাবে নাই মেয়েকে স্কুলে পড়ানো উচিত। হিরার মনের মধ্যেও কখনো উদয় হয়নি স্কুলের কথা, সারাদিন পুতুল-পুতুল, কানামাছি, বউছি খেলে আর সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের সাথে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে-ঘুরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা । এ রকম ছেলে মেয়েদের মনে স্কুলের কথা জাগবে কেমন করে? তবে হিরা সবার থেকে আলাদা। কখনো কারো জিনিসে না বলে হাত দেয় না, চুরি করার অভ্যাস মোটেও তার নেই। ওদের দলের কেউ চুরি করতে চাইলে ও(হিরা) বাধা দেয়। আজ সকালের দিকে হিরা আর হিরার বান্ধবীরা মিলে গোল্লাছুট খেলছে এমন সময় দুজন লোক এসে ওদের কাছে দাড়ালো, ওরা খেলা বন্ধ করে লোক দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল। হিরার বান্ধবী কাজুলি হিরা কে বলল, “এমন লোক তো  এগাঁও – ওগাঁও কোত্থাও দেখি নাই, ছেলে ধরা নাতো রে “। তারা জিজ্ঞাসা করল” আচ্ছা মুক্তিযোদ্ধা হারুনের বাড়ি কোনটা, তোমরা বলতে পারো?”তখন কাজুলি হিরার দিকে ইঙ্গিত করে বলল “ওর বাপের নাম হারুন “।বিষ্ময়ে হিরা বললো, ” কিন্তু আমার বাপতো মুক্তিযোদ্ধা না”! তারা বলল হারুন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন,   শুনেছি তার স্ত্রী ফুলবানু আর মেয়ে এই গ্রামেই থাকে । তারা আবার হিরাকে জিজ্ঞাসা করল “আচ্ছা, বলো ফুলবানুদের বাড়ি কোনটা? “হিরা ভয়ে ভয়ে  উত্তর দিলো, ” আমার মার নামই তো  ফুলবানু,  কিন্তু কেন খুঁজচ্ছেন আমাগোরে? মা তো বাড়ি নাই, কামে গ্যাছে ঔপাড়া। বাড়িতে আইয়েন, বয়েন। মারে ডাইক্যা নিয়া আসি”।এই বলে হিরা রওনা দিলো মাকে ডাকতে। শীত পরেছে বেশ, সূর্য উঠেছে বটে কিন্তু রৌদ্রের জোর কম, এখনো ঘাসের উপর শিশির টলমল করছে। দু – পাশে সরিষার ক্ষেত, দিগন্তের যতদূর চোখ যায় হলুদ আর হলুদ। এক গুচ্ছ  সরিষা ফুল তুলে আল রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। এমন সময় আবার লোক দুটোর কথা মনে জেগে উঠল ” উনারা মাকে ক্যান খুঁজছে”? কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরল।  তিরিং বিরিং দৌড় দিতে দিতে  মায়ের কাছে পৌঁছালো। হিরাকে দেখে ফুলবানু বলে উঠলো”তুই এখানেই চইল্যা আইছোস, বাড়িতে মন বসে না”?সেই উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো “বাড়িতে দুইডা লোক আইছে, তোমারে খোঁজে”। ফুলবানু হিরাকে অতি আগ্রহী জিজ্ঞাসা করল,”তাদের দেখতে ক্যামন রে,  হিরা “? হিরা বিশদ বর্ণনা দিলো “শার্ট, প্যান,  জুতা,মোজা পরা দেখতে সায়েব মনে হয় “। ফুলবানু মনে মনে ভাবে এমন লোক তো বাড়িতে আসার কথা না। হাতের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে। যাদের বাড়িতে কাজ করে, সেই বাড়ির কর্তা গিন্নিকে  বললো ” বু, বাড়ি যায়? কারা যেন আইছে বাড়িতে “। বলে মা ও মেয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। বাড়ির কর্তা গিন্নি বলে উঠলো, “আইজকার চাইল নিবিনা, ফুলবানু”? ফুলবানু আনমনা হয়ে বললো, “দ্যাও তাইলে, নিয়া যাই”। এক সের চাউল কাপড়ের আঁচলের মধ্যে দিতে দিতে বললো, ” তরকারি লাগলে যাওয়ার সময় ক্ষ্যাত থাইকা বাগুন আর মুলা নিয়া য্যাইস, আর এই দুইডা মুয়া হিরারে দে, কাইল রাইতে বানাইছি”।ফুলবানু মনিবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরল। হিরা সেই খই এর তৈরি মোয়া কামরাইয়া কামরাইয়া খাচ্ছে আর মায়ের পিছে পিছে হাঁটছে, খুশিতে বলে উঠলো “খালা খুব ভালা মানুষ গো মা “!
মা ও মেয়ে রাস্তা সংক্ষিপ্ত করে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দ্রুত বাড়ি পৌঁছালো। বাড়িতে এসেই দুটি ভদ্রলোক কে দেখতে পেল ফুলবানু। পরনের কাপড়ে নিজেকে  যথাসাধ্য ঢেকে নিল। মৃদু পায়ে তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। লোকদ্বয় তাকে জিজ্ঞাসা  করলো “আপনি ফুলবানু? আমরা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে এসেছি। “ফুলবানু বিষ্ময়ে জিজ্ঞাসা করল আমাগোর খুচ্ছেন ক্যান”? উত্তরে লোক গুলো বলল “১৬ ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে শিমুলতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে আপনাদের সংবর্ধনা  আয়োজন করেছি, সেখানে আপনার স্বামী  হারুন কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, কিভাবে শহীদ হয়েছে জনতার সামনে বলবেন৷ ”
দেখতে দেখতে ১৬ ই ডিসেম্বর চলে আসলো। ফুলবানু আর হিরা শিমুলতলী স্কুলে যাবে। হিরার মাথার চুল ঝুটি করে বেঁধে দিল। হাড়ির কালি দিয়ে চোখে কাজল দিয়ে দিল। হিরা মাকে নানান রকম প্রশ্ন করছে, স্বাধীনতা কি? বিজয় দিবস কি? ফুলবানু হিরাকে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করল। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলল, ওর বাবার কথা বলল। হিরার বাবার কথা বলতেই  ফুলবানুর মনটা  ভিশন খারাপ হয়ে গেলো।    আজ, স্বামীর কথা বেশ মনে পরছে। এই দিকে হিরার মনে আর আনন্দ ধরে না, কারণ সে এই প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। স্কুল দেখতে কেমন? মনে মনে নানান কিছু সাথে মিলাছে। এরই মধ্যে তারা স্কুলে উপস্থিত হল। স্কুলের মাঠ ভর্তি মানুষ। মাইকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা রকম কথা বলছে। ফুলবানু আর হিরাকে দেখে সব মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল । মঞ্চে প্রধান অতিথির আসনে ফুলবানুকে বসানো হলো।  তারপর  ফুলের মালা দিয়ে মা ও মেয়েকে বরণ করে নিল। এর কিছুক্ষণ পর ফুলবানুকে ডাকা হল কিছু বলার জন্য। কোনদিন ফুলবানু মাইকে এবং এতো মানুষের সামনে কথা বলে নাই। মাউথপিস হাতে নিয়ে কম্পিত স্বরে বলতে শুরু করলো, “আমি মুক্তিযোদ্ধা হারুনের বউ। শেখ সাহেবের ভাষণ শুইন্যা আমার স্বামী আমাকে বলে হিরার মা হোনো, দ্যাশে যুদ্ধ লাগবার পারে। যদি যুদ্ধ শুরু হয় যুদ্ধ করতে হইবো, দ্যাশ স্বাধীন করতে হইবো। আমি তহন বলেছি কি দিয়ে যুদ্ধ করবা হালের লাঠি দিয়া, বন্দুক পাইবা কোনে? আঙ্গের হে, হাসতে হাসতে কয় এ নিয়া তোমার চিন্তা করন লাগবোনা হিরার মা, এক ব্যবস্থা হইবোই। দ্যাশে যহন যুদ্ধ শুরু হইল মানুষ আর মানুষের ঘরে থাকবার পারেনা, মানুষগুলো হানাদোরের ভয়ে পলাইয়া পলাইয়া থাহে। হিরার বাপ কোন দিন বাড়িতে থাহে আবার কোনদিন বন জঙ্গলে। শীতের দিন তাড়াতাড়ি আইন্দা হিরারে নিয়ে শুয়া আছি, হিরার বাপ আর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রাইতে ভাত খাইতে আইছে। ভাত খাওয়া প্রায় শেষ, এমন সময় চেয়ারম্যান বাড়ির কামলা ডাইকা বলত্যাছে হারুন ভাই বাড়ি আইসো? চেয়ারম্যান কাকা এ্যাখনি দেহা করবার কইছে! ভাত খাইয়া শ্যাষ কইরা যাওয়ার সময় আমারে কয় হিরার মা হিরারে দেইখা রাইখো। আমি হিরারে বিছানায় শুয়াইয়া রেখে পিছনে পিছনে গ্যালাম, আড়াল থাইকা দেহি ‘জালাল খাঁ ‘ এর বাড়িত অনেক মানুষ, আমার পাও ডরে কাপতাছে। শুনবার পাইলাম তারা হিরার বাপেরে বলত্যাছে, তোরা নাকি দেশ শত্রুমুক্ত করবি, স্বাধীন করবি! মরবার ইচ্ছে করছে তোদের। এই যে দেখতে পাইছোস পাকিস্তানের পতাকা, এটাই এদেশে উরবো। পাকিস্তান জিন্দাবাদ বল? হিরার বাপ চিৎকার করে কয় “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”। চেয়ারম্যান কয় দেখছোস  সাহস কত বড়, আমার সামনে কয় “জয় বাংলা”। অস্ত্র কোথায় রাখছোস বল? হিরার বাপ কয় আমি জানিনা, জানলেও কমু না। এরপরে চেয়ারম্যান কয় শালারে শেষ করে দে। হিরার বাপের বুকে বন্দুক দিয়ে তিনটি গুলি করল, হিরার বাপ মাটিতে পড়ে গেল, আমি ডরে এক দৌড় দিয়া বাড়ি চইলা আইসা হিরারে শক্ত করে জড়াইয়া ধরলাম। তারপরে হিরার বাপের লাশ বাড়ি নিয়ে আইলো।তারা আমারে কয় বন্দুক  কোথায় বল? আমি ডরে বের করে দিলাম। তারা বিড়-বিড় করে বললো দেখব কেমনে দেশ স্বাধীন করে।
দ্যাশ সত্যিই স্বাধীন হলো। কত বছর কেটে গেল আমাগোর কোন পরিবর্তন নাই, খাইয়া না খাইয়া দিন যায়। হিরার বাপ একটা কথা  বার-বার কইতো “দেখবা দেশ স্বাধীন হইলে আমাগোরে আর দুঃখ থাকবো না, হিরার মা”! হিরার বাপের এই কথা মিথ্যা হইল। দ্যাশ স্বাধীন হলো কিন্তু দুঃখ গ্যালো না। মনে মনে ভাবতাম একদিন এই দুঃখ যাইবোই। যেদিন হুনলাম  শেখ সাহেবরে মাইরা ফালাইছে, হেই দিনই আমাগোর কপালের উপর কুড়াল পরছে, সুখ পালাইয়া গেছে। এরপর থাইকা  আর ভাবি নাই সুখের কথা।  কারণ,আমাগোর দিন এমনি কইরায় যাইবো। আইজক্যা আপনারা আমাগোরে ফুলের মালা দিতেছেন ক্যান ? এই ছেঁড়া কাপড় কি আমাগোর স্বাধীনতা? না খাইযা থাকার জন্য কি সবাই যুদ্ধ করছে? এটাই কি আমাগোর স্বাধীনতা ! ” বলে গলার ফুলের মালা খানা খুলিয়া মঞ্চে সুড়ে ফেলল । তারপরে ফুলবানু একটি কথাও বলতে পারল না, আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মঞ্চ থেকে নেমে পরল।

সবুজ মাহমুদ
বাইপাইল, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button