ধারাবাহিক গল্প

শ্রাবণ আঁধারে পর্ব ১২

কলমে নিশাত জাহান নিশি

 

“আসলে আমি চিএা দাসের বন্ধু “মৃনালীর খুড়তুতো ভাই।” মৃনালীর সুসাইডের ব্যাপারে চিএা দাসের সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো। একাডেমীর সামনে প্রায় ১ সপ্তাহ যাবত আমি ঘুরাঘুরি করছি তবে একাডেমীর অভ্যন্তরীণ কেউ চিএা দাসের পরিচয় আমাকে দিচ্ছেন না! চিএা দাসের মুখের আদল না চেনার দরুন আমি সারাক্ষণ একাডেমীর সামনে ঘুড়ে ও চিএা দাসকে চিহ্নিত করতে পারছি না।”

যৃবকটির প্রতিটা কথা শ্রবণ করা মাএই কেনো জানি না আমার মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সমতা হ্রাসের পথে নেমে এলো। ফট করে মাথাটা সাংঘাতিক ভাবে ধরে এলো। অজানা কোনো আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্রমান্বয়ে শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলে আমি যুবকটির দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিগ্যাসু কন্ঠে বললাম,,

“চিএা দাসের সঙ্গে ভিক্টিমের সুসাইড কেইসের কি সম্পর্ক? পুলিশ তো আমাদের কিছুদিন পূর্বে ইনফর্ম করেছিলেন, সুইসাইড নোটে লিখা, চিএা দাসের নামের সঙ্গে ভিক্টিমের কোনো রিলেটিভসের নাম মিলে যায়। ভুলবশতই কেইসটাতে চিএা দাসের নামটা জড়িয়ে পড়ে। এতোটা ভেরিফিকেশানের পরে ও কেনো আপনি আবার চিএা দাসকে খুঁজতে এলেন?”

যুবকটি চোখে, মুখে বিষাদের ছাপ ফুটিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ম্লান কন্ঠে বলল,,

“পুলিশ শুধু আমাদের না আপনাদের ও বিভ্রান্ত করেছিলেন। চিএা নামের কোনো রিলেটিভসই আমাদের গোএে বা বংশে নেই। সবটাই সাজানো গোছানো একটা ভয়ঙ্কর চাল ছিলো মাএ!”

অপার বিস্ময় নিয়ে আমি জিহ্বা দ্বারা শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে ছোট আওয়াজে বললাম,,

“চলুন আমরা নিরিবিলি কোনো স্থানে বসি। আপনার সাথে অতিব জরুরী কিছু কথা আছে আমার। অনেক কিছু জানার ও আছে। হয়তো দুজনই একই রহস্যের সমাধান খুঁজছি। দুজনেরই গন্তব্য পথ এক!”

যুবকটি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে চাঁপা কন্ঠে বলল,,

“চলুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে নিঃসন্দেহে আপনাকে বিশ্বাস করা যায়। এছাড়া ও আমার মন ইঙ্গিত দিচ্ছে আপনি অনেক কিছু জানেন। আপনার থেকেই আমি নিঃসংকোচে সাহায্য প্রার্থণা করতে পারি।”

যুবকটিকে নিয়ে আমি একাডেমী থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত একটা শিশু পার্কে বসলাম। সিমেন্টের তৈরী বেঞ্চিতে আমরা দুজনই মাথায় অসংখ্য প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে পাশাপাশি বসে আছি। পার্কের আশপাশটা কোলাহলপূর্ণ হলে ও আমরা যে পাশটাতে বসেছি, ঐ পাশটা খুব নিরিবিলি এবং নির্ভেজাল। লোকজনদের কোলাহল আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কথা বার্তায় অন্তত বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। মস্তিষ্ক ভর্তি উদগ্রীবতা নিয়ে আমি যুবকটির মুখোমুখি বসে শান্ত কন্ঠে বললাম,,

“আপনার পরিচয়টা আগে দিন। আপনার নাম, গ্রামের নাম এবং আপনার ঠিকানা!”

“আমি হিমাংশু সেন৷ কোটালীপাড়ায় আমার গ্রাম। পেশায় ছোট খাটো রিপোর্টার আমি। যদি ও এখনো খুব বড় একটা পর্যায়ে যেতে পারি নি, তবে চেষ্টায় আছি!”

হিমাংশু দম নিয়ে পুনরায় বলল,,

“এবার আপনার পরিচয়টা দিন?”

আমি অনর্গল কন্ঠে বললাম,,

“আমি আরাধ্য, আরাধ্য সেনগুপ্ত। এই পাড়ার জমিদারের ছেলে আমি। চিএা “আমার অর্ধাঙ্গিনী।” বিষয়টা অতি গোপনীয়৷ আমি, চিএা এবং শ্বশুড় মশাই বাদে, আজ আপনি জানলেন!”

হিমাংশু আচমকা মাথা নিচু করে গলা জড়ানো কন্ঠে বলল,,

“সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো, এতোদিনে মৃনালীর সাথে আমার বিয়েটা ও হয়ে যেতো। মৃনালী ও আমার অর্ধাঙ্গিনী হতো!”

“মৃনালীকে আপনি ভালোবাসতেন?”

হিমাংশু টলমল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ভীষণ। ভাবতে পারি নি আসলে, মৃনালী হঠাৎ করেই এতো বড় ভুল একটা স্টেপ নিয়ে নিবে৷ নিজেকে এভাবে নিঃশেষ করে দিবে।”

“আপনার কি মনে হয়? মৃনালীর হঠাৎ সুইসাইডের কারণ কি হতে পারে?”

“কোনো একটা বড় কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। যা পুলিশ প্রশাসন এবং মৃনালীর পরিবার আমাদের সব্বার থেকে গোপন করছেন। মুখ খুলে সত্যিটা প্রকাশ করতে পারছেন না হয়তো বা চাইছেন না। আশ্চর্যের বিষয় এই হলো যে, সুইসাইড নোটটা ও এখন পুলিশ প্রশাসন আমার হাতে তুলে দিতে চাইছেন না। মৃনালীর সুইসাইডের বিষয়ে কোনো প্রসঙ্গই তারা তুলতে চাইছেন না। যতোবারই আমি চেষ্টা করছি মৃনালীর ধর্ষণ এবং সুসাইডের বিষয়টা উনাদের কানে তুলতে, ততোবারই যেনো উনারা বিভিন্ন অযুহাতে আমাকে নিঁখুতভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, দাহের ঠিক দুইদিন পরই মৃনালীর পরিবার কেইসটা তুলে নিয়েছিলেন। কারনটা জিগ্যেস করতেই উনারা আমাকে আজ ভাজ বুঝিয়ে বিষয়টাকে ধামা চাঁপা দিতে চাইছেন। মৃনালীকে কে বা কারা ধর্ষণ করেছিলো, তা জানার প্রয়োজন ও উনারা মনে করছেন না।”

হিমাংশু আকস্মাৎ হু হু শব্দে কেঁদে চাঁপা কন্ঠে বলল,,

“খুব ভালোবাসতাম আমি মৃনালীকে। যখন জানতে পারলাম ভালোবাসার মানুষটার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, খুশিতে আত্নাহারা হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। সেই খুশিকে মুহূর্তের মধ্যে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে মৃণালী চলে গেলো আমাকে ছেড়ে বহু ক্রোশ দূরে৷ একবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করল না, তার ভেতরে চলতে থাকা অদৃশ্য যন্ত্রণা গুলো, কষ্টের কারণ গুলো!”

কেনো জানি না, আমার ভেতরটা ও হুহু শব্দে কেঁদে উঠল৷ কোনো এক অজানা ভয়ে আমার হৃদয়টা ও কাঁদছে। তবে একটা বিষয় আমি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি, আমার চিএা ও এই বিষয়গুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। জেনে বুঝেই মৃনালী তার সুইসাইড নোটে চিএার নামটা ঠিকই উল্লেখ করে গিয়েছিলো। সেই সূএ ধরেই পুলিশ প্রথমত ঠিক দিকেই এগুচ্ছিলেন, পরবর্তীতে হয়তো বড় কোনো কুচক্রী মহল কেইসটা ঘুড়িয়ে চিএার উপর থেকে তকমাটা তুলে অন্য দিকে কেইসটার মোড় দিয়েছিলেন। ঐ মুহূর্তে চিএার ভাব ভঙ্গি দেখে আমি কিছুটা হলে ও আঁচ করতে পেরেছিলাম। বারংবার মনে হচ্ছিলো চিএা শতভাগ নিশ্চিন্ত ছিলো কেইসটা কোনো ভাবে ঘুড়ে যাবে। তার গায়ে অপরাধীর তকমাটা মোটে ও লাগবে না। নিজের প্রতি কনফিডেন্স ছিলো তার দ্বিগুন। পুরো ঘটনাটায় তার গাঁ ছাড়া ভাব ছিলো বিদ্যমান৷ ঐ দিন চিএার সাথে করা পুলিশ অফিসারের বিরূপ প্রতিক্রিয়াটা ও আমার খুব একটা সুবিধার ঠেঁকছিলো না। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টাই আমার খুব সন্দেহের ঠেঁকছিলো। ইদানিং চিএার করা প্রতিটা হেয়ালীপূর্ণ আচরণ, আমার মনে অধিক সন্দেহের সৃষ্টি করছে৷ ভয়ঙ্কর কিছু একটা নিশ্চয়ই চিএা ঘটাচ্ছে। হয়তো সাংঘাতিক কোনো ট্রেপে ফেঁসে গেছে। যা আমার কাছে শেয়ার করতে চিএার কুন্ঠাবোধ এবং ভয়ভীতি কাজ করছে।

নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ বুঝাপড়া করে আমি কান্নারত অবস্থায় থাকা হিমাংশুর কাঁধে হাত রেখে শান্তনার স্বরে বললাম,,

“কাঁদবেন না হিমাংশু। যদি ও আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি, তবু ও বলব কাঁদবেন না। আপনার মৃনালীকে ন্যায় দেওয়ার দায়িত্ব আমি সমভাবে নিজের কাঁধে ও তুলে নিলাম৷ গুপ্ত যতো রহস্য আছে সব আমরা ভেদ করব। এক্ষনি আমরা চিএার বাড়ি যাবো। চিএার মুখ থেকে আসল সত্যিটা বের করতেই হবে আমাদের।”

কান্না থামিয়ে হিমাংশু ছলছল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। উনাকে অভয় দিয়ে আমি চিএার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে আমরা চিএার বাড়ি এসে পৌঁছলাম। ঘড়িতে রাত ৮ টা বাজছে। ঐদিকে শর্মিলার ফোন থেকে অনবরত আমার ফোনে কল আসছে। হয়তো শর্মিষ্ঠার বিয়ের লগ্ন আরম্ভ হয়ে গেছে। শর্মিলার ফোনকলে কোনো রূপ ভ্রুক্ষেপ না করে আমি চিএার বাড়ির গেইটে পা রাখতেই রুমের প্রতিটা দরজায় তালা ঝুলানো দেখলাম। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে আমি প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে শর্মিলার নাম্বারে কল ব্যাক করতেই শর্মিলা কলটা তুলে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,,

“দাদা কোথায় তুমি?”

আমি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললাম,,

“আগে বল, চিএা কোথায়?”

“চিএা দি তো আমার পাশেই আছে। অনেকক্ষণ আগেই এসেছে চিএা দি। এসেই তোমাকে খুঁজেছে। এছাড়া ও বাড়ির সবাই তোকে খুব খুঁজছে দাদা৷ প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো! দিদির বিয়ের অনুষ্ঠান আরম্ভ হতে চলল।”

কলটা কেটে আমি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে হিমাংশুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বললাম,,

“আমার সাথে, আমার বাড়ি চলুন। চিএা ওখানেই আছে!”

হিমাংশু ক্ষীন হেসে বলল,,,

“চলুন।”

,
,

রাত ১০ টা। শর্মিষ্ঠার বিয়ে মাএ শেষ হয়েছে। হৈ, হুল্লোড়ে সবাই বাসর জাগছে। চিএাকে বাসর থেকে উঠিয়ে এনে আমি এবং হিমাংশু সহ আমাদের বাড়ির পেছনের দিকটায় চলে এলাম। চিএা খুব সেজেছে আজ। আমার আনা লাল শাড়ি, চুড়ি, বিন্দি, আলতা, গাজরা ফুল সব দিয়ে সেজেছে আজ৷ স্বরস্বতি মায়ের প্রতিমূর্তি মনে হচ্ছে চিএাকে৷ সিঁথির এক কোণায় এক চিলতে সিঁদুর লেগে আছে৷ দূর থেকে সিঁথিটাকে শূণ্যই মনে হচ্ছে। হিমাংশু সেনকে দেখার পর থেকেই চিএা কেমন উশখুশ করছে, ভয়ে সিঁধিয়ে আছে। কথা বলতে তার গলা জড়িয়ে আসছে। বুঝতে পারছি, চিএা ভীষণ আতঙ্কে আছে।

বাড়ির পেছনের বিশাল শিমুল গাছের তলায় আসতেই চিএা এক ঝটকায় আমার হাতটা সরিয়ে কম্পিত চোখে একবার হিমাংশুর দিকে চেয়ে পরক্ষনে আমার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“বাসর থেকে উঠিয়ে আনলি কেনো আমায়? কি হয়েছে বলবি?”

আমি তটস্থ কন্ঠে বললাম,,

“আজ তোর রেহাই নেই চিএা। তোকে আজ সত্যিটা বলতেই হবে। মৃনালীর সুইসাইডের রহস্য তোকে আজ বলতেই হবে। কোনো ছাড় নেই আজ তোর বুঝেছিস?”

চিএা চোখ, মুখ উল্টিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই বড় বড় নিশ্বাস নির্গত করে কম্পিত কন্ঠে বলল,,

“আআআমি কিছু জানি না। মৃমৃমৃনালীর সুসুসুইসাইডের বিষয়ে আআআমি কিছু জানি না।”

ঝড়ঝড়িয়ে কেঁদে দিলো চিএা। হিমাংশু কান্না জড়িত কন্ঠে চিএার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিনতির স্বরে চিএার সামনে দুহাত জোর করে বলল,,

“আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি চিএা। আপনি যাই জানেন, যতটুকু জানেন, দয়া করে ততটুকুই আমাদের অবহিত করুন। আপনার বয়ানের উপর হয়তো মৃনালীর ন্যায় নির্ভর করছে, মৃনালীর আত্নার শান্তি নির্ভর করছে। এই অসহায় প্রেমিকের শেষ অনুরোধটা আপনি রাখুন প্লিজ। দরকার প্রয়োজনে আমি আপনার পায়ে ধরতে রাজি। আপনি যাই বলবেন আমি তাই করতে রাজি। প্লিজ আপনি একবার সত্যিটা খুলে বলুন। আমার মৃনালীর আত্নার শান্তি রক্ষার্থে হলে ও আপনি আমাদের সাহায্য করুন।”

চিএা এক রত্তি ও গলল না। শাড়ির আঁচল চেঁপে ফুঁফিয়ে কেঁদে পিছু ঘুড়ে বাড়ির ভেতরে দৌঁড়ে মোড় নিতেই আমি পেছন থেকে হেচকা টানে চিএাকে আমার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে চোয়াল শক্ত করে ঠাস ঠাস করে চিএার দু গালে দু চড় বসিয়ে বলল,,

“ন্যাকামো শিখে গেছিস খুব তাই না? জেনে বুঝে একজন অসহায় মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিস? নিজেকে খুব বড় এবং মহান ভাবছিস তুই তাই না? অহং কাজ করছে তোর মধ্যে হুম? খুব অহং কাজ করছে? ভাবছিস লোকটা তোর পায়ে পরলে হয়তো তোর স্টেটাসটা বড় হবে? সবাইকে তোর পায়ের তলায় ফেলতে খুব ইচ্ছে জাগছে না? নিজের ইগু সেটিজফাইড করতে চাইছিস তুই?”

গভীর শোক নিয়ে চিএা দু গালে হাত দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আধো স্বরে বলল,,

“আমি বেঁচে থাকতে তোর কোনো ক্ষতি হোক আমি চাই না আরাধ্য৷ নিজের চুল পরিমান ভুলের জন্য আমি আমার সিঁথি ফাঁকা করতে চাই না বিশ্বাস কর৷ আমি অতোটা ও মহান নই যে, নিজের ভালো থাকার কারণটাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লাগব৷ এই বিষয়টাতে আমি খু্ব স্বার্থপর আমি জানি। কিন্তু কি করব বল? এই নিষ্ঠুর, নির্মম পৃথিবীতে তুই ই তো আমার বেঁচে থাকার একমাএ কারণ। তোর কিছু হয়ে গেলে যে আমি ও বাঁচব না আরাধ্য!”

চিএা এক মুহূর্ত ও দাঁড়ালো না। দু হাতে শাঁড়ির কুঁচি সামলে ভৌঁ দৌঁড়ে আমার চোখের সম্মুখ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। অনেক পূর্বেই খোঁপা থেকে চিএার গাজরা ফুলটা খসে পড়ল আমার পায়ের কাছে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমি গাজরাটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই মুহূর্তে আমার অনুভূতি প্রায় শূণ্য পর্যায়ে ঠেঁকেছে৷ ফাঁকা মাথায় কিছুই ভাবতে পারছি না। গলাটা কেমন জড়িয়ে আসছে আমার। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছি না মোটে ও। শরীরটা সাইক্লোনের বেগে নড়ছে। ইতোমধ্যেই হিমাংশু আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,,

“চলুন আমরা চিএা দেবীকে অনুসরন করি। উনার ভাব ভঙ্গিমাতে বুঝাই যাচ্ছে উনি অনেক কিছু জানেন। হয়তো কোনো ভয়ে আমাদের বলতে চাইছেন না৷ উনার সেই মনের ভয়টা আমাদের কাটাতে হবে।”

অল্প সময় মৌণ থেকে আমি স্থির দৃষ্টিতে হিমাংশুর উদগ্রীব চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“আপনি আজ বাড়ি ফিরে যান হিমাংশু। চিএার মুখ থেকে আমরা কোনো সত্যিই বের করতে পারব না। আগামীকাল আমরা দুজন সরাসরি একাডেমীতে যাবো। ঠিক সকাল ১০ টায় আপনি একাডেমীতে উপস্থিত থাকবেন। কেঁচো ঘেঁটে কিভাবে কেউটে বের করতে হয় তা খুব ভালোভাবেই রপ্ত আছে আমার।”

হিমাংশু মুখে গুরুগম্ভীর ছাপ ফুটিয়ে মাথা নিচু করে বললেন,,

“আপনার যা ইচ্ছা। কাইন্ডলি আপনার ফোন নাম্বারটা দিবেন?”

গড়গড় করে আমি সম্পূর্ণ ফোন নাম্বারটা হিমাংশুকে বললাম। নাম্বারটা উনি ফোনে তুলে হাসিমুখে আমার থেকে বিদায় নিলেন। যাওয়ার পূর্বে আমার ফোন নাম্বারটায় ছোট একটা মিসড কল দিয়ে গেলেন। উনার নাম্বারটা ফোনে সেইভ করে আমি হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে ছুটে এলাম। গাঁ থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে আমি বালিশের তলা থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দু দুটো সিগারেট একসাথে জ্বালালাম। শরীরের প্রতিটা শিরা, উপশিরায় আমার আগুন জ্বলছে। গাঁ থেকে জবজবিয়ে ঘাম ঝড়ছে। কপালের ভাঁজে প্রখর উত্তেজনা এবং হাজারো অজানা প্রশ্নের ছাপ। সিগারেট দুটো অনবরত ফুঁকে আমি ব্যালকনীর ইজি চেয়ারটায় বসতেই পায়জামার পকেটে থাকা আমার ফোনটা উর্ধ্বগতিতে ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমি স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই ফোনটা রিসিভ করতেই ঐ পাশ থেকে অচেনা কোনো পুরুষ উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন,,

“আপনি আমাকে চিনবেন না দাদা, আমি ও আপনাকে চিনি না। এই ফোনের মালিক এই মাএ এক্সিডেন্ট করেছে, বাঁচার আশা দুরাশা। কল লিস্টে আপনার নাম্বারটা পাওয়া মাএই আমি কলটা করলাম। দয়া করে আপনি গোপালগঞ্জ বাজারে চলে আসুন।”

তব্দিত হয়ে আমি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখ জোড়া কৌতুহল নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই হিংমাশুর ফোন নাম্বারটা অবলোকন করতে পারলাম। হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে আমি সিগারেট দুটো মাটিতে পিষে পাঞ্জাবিটা কোনো রকমে গাঁয়ে জড়িয়ে আতঙ্কে বশীভূত হয়ে ছুটে চললাম গোপালগঞ্জ বাজারের উদ্দেশ্যে!

 

 

পর্ব সমাপ্ত 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button