গল্প

সুলতান মাহমুদের গল্প বুদ্ধিজীবী নদু মাস্টার

নদু মাস্টারের নামডাক আশেপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের বুদ্ধি নিজের ক্ষেত্রে কোন কাজে না লাগলেও অন্যদের বেলায় বেশ কার্যকরী। অন্যকে জ্ঞান বিতরণ করলেও নিজে সবসময় বউয়ের বুদ্ধিতে চলে। নদু মাস্টার আসলে কোন স্কুল কলেজের মাস্টার নয়। কিছুদিন সিনেমা হলের টিকেট মাস্টার হিসেবে কাজ করতে গিয়েই এই মাস্টারি নাম কামাইছে। নদু সেই স্কুল জীবন হতেই বুদ্ধি বিতরণ করে আসছে। স্কুলে থাকতে একবার এক বন্ধুর প্রেম ঘটিত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে একেবারে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। সে আজও মনে মনে নদুকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। আবার কলেজে পড়ার সময় মাঝ বয়সী এক মহিলার সাথে পরকীয়া বিষয়ক সমস্যা নিয়ে এক বন্ধু আসলে নদু গৃহ শিক্ষক হয়ে ঐ মহিলার বাসায় ঢুকে প্রেমের মাস্টার হয়ে বন্ধুকে মুক্তি দিয়েছিল।
এই তো বছর পাঁচেক আগে পাশের গ্রামের এক লোক এসে বউয়ের সাথে বনিবনা হচ্ছে না বলে নদুকে জানায়। নতুন একটা প্রেম করার বুদ্ধি দিয়ে লোকটিকে বিদায় দেয়। গোপনে নিজের সাবেক প্রেমিকাকে লোকটির দিকে লেলিয়ে দেয়। আর ঐ লোকের বউয়ের সাথে নদু নিজেই প্রেম করতে শুরু করে। সোনার গয়না, দেনমোহরের টাকা পয়সাসহ লোকটির ডিভোর্সী বউ আজ নদু মাস্টারের ঘরের লক্ষ্মী। এমন কোন সমস্যা নেই, যার সমাধান নদু মাস্টারের কাছে নেই। চিকন বুদ্ধি,মোটা বুদ্ধি,সুবুদ্ধি, কুবুদ্ধিতে মাথা সবসময় গিজগিজ করে। একবার এক ছেলে প্রেম না করেই প্রেমের অনুভূতি বুঝতে চাইল। এই  জটিল সমস্যার সমাধান দিতে ছেলেটাকে এক বৈদ্যের কাছে পাঠায়। এক মাস পরে তার মৃত্যু হবে বলে বৈদ্য জানিয়ে দেয়। ছেলেটা মরণের কথা শুনে অস্থির হয়ে যায়। কোন কাজেই মনোযোগ দিতে পারেনা,সবসময় মরণের কথা ভাবতে থাকে। টাকা পয়সার প্রতি মায়া মমতা হারিয়ে যায়। সময়মত খাওয়া নাওয়া ভুলে ছেলেটা কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে যায়। এক মাস পরেও ছেলেটির মৃত্যু না হওয়ায় নদু মাস্টারের কাছে যাওয়া মাত্রই নদু বলে, “এই এক মাস তোমার যেমন লেগেছে নতুন নতুন প্রেম করলে প্রেমিকার জন্যও ঠিক সেরকই অনুভূতি হয়।” একথা শুনে ছেলেটা রাগে ক্ষোভে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি ফিরে যায়। দিনরাত নানান ধরনের সমস্যার কথা শুনতে শুনতে নদু মাস্টারের কানের পর্দা এতটাই পাতলা হয়েছে যে, এখন সে পশু পাখিদের কথাও বুঝতে পারে আর তাদের সমস্যার সমাধানও দিতে পারে।
সেদিন বাজার থেকে আসার সময় একটা বন বিড়াল ডেকে বলল- মাস্টার মশাই,মাস্টার মশাই, কারো লম্বা লেজ নিয়ে খেলা করতে আমার খুব ইচ্ছে করে। আমি কিভাবে এই শখ পূরণ করতে পারি? নদুর চিকন বুদ্ধি মতে বনবিড়ালটা মাঠে চড়ানো একটা ষাঁড়ের লেজ নিয়ে খেলতে লাগল। ষাঁড়টা এতে বিরক্ত হয়ে বনবিড়ালকে তাড়ানোর জন্য কষে একটা লাথি মারল। ষাঁড়ের লাথিতে বনবিড়ালটা ১৫/২০ হাত দূরে গিয়ে পড়ল। বুকের দুটি হাড় ভেঙে গেল। তীব্র ব্যথা নিয়ে কোনরকমে বনবিড়ালটা বনে চলে গেল। কারো লেজ নিয়ে খেলা করার শখটাও চিরতরে মিটে গেল।
আবার একদিন বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা খরগোশ এসে নদু মাস্টারের কাছে পরামর্শ চাইল,কিভাবে বনের রাজা সিংহকে তার পদ থেকে সরিয়ে তাদের নেতা হাতিকে রাজার আসনে বসাতে পারে? নদু মাস্টার খরগোশটিকে বুদ্ধি দিল,কঠোর আন্দোলন করে সিংহকে ক্ষমতাচ্যুত্য করতে হবে। এখনই বনের নিরীহ পশুদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। খরগোশটি সুন্দর বুদ্ধি পেয়ে হাতির সাথে পরামর্শ করে সেদিনই মিটিং ডেকে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। নদু মাস্টার আবার সিংহের আইন উপদেষ্টা শিয়ালকে ডেকে খরগোশদের আন্দোলনে বিঘ্ন ঘটাতে মানা করল। শুরু হলো খরগোশদের তুমুল আন্দোলন আর মিছিল। সিংহের পতন আসন্ন!
শিয়াল ছুটল নদু মাস্টারের কাছে পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে। নদু মাস্টার পরামর্শ দিল, বনের বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অজুহাতে বিপরীত দলের সব নেতাকে গ্রেফতার করে আটকে রাখতে। পরামর্শ মত বিপক্ষ দলের হাতি,খরগোশ সহ সব নেতাদের ধরে ইচ্ছে মত ধোলাই দিয়ে গহীন বনে কড়া পাহারায় বন্দী করে রাখল আর সমস্ত বনে কড়া হুশিয়ারী ঘোষণা করল, কেউ আন্দোলনের নামে মিছিল বা ভাংচুর করলে তার পরিনতি হবে মৃত্যু। বনের সব আন্দোলন  থেমে গেল। সিংহ রাজা খুশি হয়ে নদু মাস্টারকে তার মন্ত্রীসভার আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিল। বনের মধ্যে দুর্বল প্রাণীদের উপর সিংহের অত্যাচার, অবিচার আরো বেড়ে গেল। কিছুদিন পরেই বনের সমস্ত ছোট বড় নিরীহ প্রাণী মিলে আবার আন্দোলন শুরু করল। সবার মধ্যে মশা,পিঁপড়া, মৌমাছি, ইঁদুরদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হলো। সিংহের পক্ষের প্রাণীরা পায়ে  পিঁপড়ার কামড় আর গায়ে মশা,মৌমাছির কামড়ে উন্মাদের মতো লাফালাফি করতে লাগল।ইঁদুর তার দাঁত দিয়ে বেড়া কেটে হাতি,খরগোশ সহ নেতাকে মুক্ত করে দিল। সম্মিলিত আক্রমণে সিংহের পক্ষের প্রাণীরা পালাতে শুরু করল। অবস্থা বেগতিক দেখে শিয়াল যেয়ে হাতির পক্ষ অবলম্বন করল। সিংহ একা হয়ে পড়ল। সিংহ বন্দি হওয়ার আগে নিজের আইন উপদেষ্টা নদু মাস্টারকে বনে তলব করল।

Related Articles

Back to top button