গল্প

যমুনার ঘোলা জলে – জাকির আলম

তখন জীবনটা অনেক সহজ সরল ছিলো। অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতাম। জীবন যাত্রা ভালোই চলছিলো। কখনো কোনো কষ্ট পেলেও মনের মধ্যে পুষে রাখতাম না। স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু মেনে নিতাম। চাহিদা বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। ছোটবেলা থেকে আমি অনেকটা চাপা প্রকৃতির। কম কথা বলতে ভালোবাসি। কখনো কারো সাথে তর্কে জড়াতাম না। সবসময় সঠিক পথে নিজেকে পরিচালিত করতাম। কারো ক্ষতি করার কথা ভুলেও ভাবতাম না। বরং কারো উপকার করতে পারলে অনেক ভালো লাগতো। মন দিয়ে লেখাপড়া করতাম। জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম না। মোট কথা সবকিছু আমার ভালো ভাবেই চলছিলো। এমন সময় উল্কার মতো আমার জীবনে তোমার আগমন। তোমার হাত ধরেই প্রেমের জগতে পদার্পণ। একটা সময় গভীর প্রেম হয়ে গেলো তোমার সাথে। শুরু হলো তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখা। ভাবনা জুড়ে শুধু তুমি। সবসময় তোমার কথা মনে পড়তো। একদিন তোমাকে দেখতে দেখতে না পেলে তোমার বাসা অবধি চলে যেতাম এক নজর দেখার জন্য। তোমার ভালোবাসা পেয়ে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম।নিজের বলে কিছু ছিলো না। সবকিছু ছিলো তুমি কেন্দ্রিক। ভালো লাগতো তোমার সাথে ঘুরে বেড়াতে। ভালো লাগতো তোমাকে গান শোনাতে। মনে পড়ে আমার গানের তালে তালে তুমি হাত তালি বাজাতে। কতো আপন করে তোমাকে নিয়েছিলাম আমার জীবনে। তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগতো না। তোমার সাথে কথা না হলে আমি পাগল হয়ে যেতাম। কথা না বলা অবধি মন ভালো হতো না। কখনো না খেয়েও থেকেছি তোমাকে হারানোর ভয়ে। মন প্রাণ উজাড় করে তোমাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। আমার অনুভূতির সবটা জুড়েই তুমি ছিলে। আমার থেকে কখনো তোমাকে আলাদা করতে পারতাম না। তুমি আমার হৃদপিণ্ডে মিশে গিয়েছিলে। তোমাকে কাছে না পেলে মনটা অস্থির হয়ে যেতো। আহত পাখির মতো মনটা ছটফট করতো। ধমনীর ভিতর থেকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। দ্বিতীয় কিছু ভাবতে পারতাম না তোমাকে ছাড়া। কতো না স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে। তোমাকে আমার মনের কাবায় রেখে ছিলাম। যেখানে প্রতিনিয়ত তোমাকে আমি ভালোবাসার অর্ঘ্য দিতাম। অসম্ভব ভালোবাসায় তোমাকে জড়িয়ে ছিলাম। হাজার বছর তোমার সাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তোমার হাত ধরে স্বর্গ-মর্ত্য পরিভ্রমণ করতে। তোমার সুবাসিত চুলের  গন্ধ শুঁকে অমিয় সুধা পান করতে চেয়েছিলাম। তোমার চোখে চোখ রেখে অনায়াসেই হারিয়ে যেতাম দূর পৃথিবীর অভিমুখে। যেখানে হাতছানি দিতো ভালোবাসার কোমল পরশ। তোমার হাতের স্পর্শ পেলেই শরীর জুড়ে কাঁপন উঠতো। তখন মনে হতো মনের খাঁচায় তোমাকে বন্দী করে রাখি। আবার কখনো বা মনে হতো তোমার আকাশে গাঙচিলের মতো ডানা মেলে মনের সুখে আকাশে উড়ে বেড়াই। কিন্তু সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে আমার জীবন থেকে তুমি বহুদূর হারিয়ে গেলে। যাওয়ার আগে একবার বলে যাওয়ার অবকাশও পেলে না তুমি। জানিনা কোন অভিমানে নীরবে চলে গেলে আমার জীবন থেকে। তুমিই প্রথম ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে ছিলে। আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলে। অথচ আজ তুমিই উধাও হয়ে গেলে আমার জীবন থেকে। তোমাকে হারিয়ে কতোটা কষ্টে আছি বলে বুঝাতে পারবো না। জানিনা কোন ঠিকানায় তুমি পাড়ি দিয়েছো। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। তুমি বলেছিলে সারা জীবন আমার পাশে থাকবে। স্বপ্ন সুখের ঘর বাঁধবে। অনেক বেশি আদরে আমাকে রাখবে। তবে কি সবকিছু তুমি ভুলে গেছো ? খুব কি সুখে আছো আমাকে কষ্ট দিয়ে ? বিশ্বাস করো জান তোমাকে ছাড়া সত্যি ভালো নেই আমি। সবসময় মনে পড়ে তোমাকে। ভীষণ মনে পড়ে গো ! আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস এবং অনুভূতির মাঝে মিশে আছো তুমি। তোমার স্মৃতি অনেক ভয়ানক। তোমাকে ছাড়া খুব কষ্ট হয় আমার। ঘুমাতে পারিনা তোমার কথা ভেবে। আজ আমি চুপসে গেছি। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। নিজের যত্ন নিতেও ভুলে গেছি। নিজেকে চিনতে এখন বড্ড ভুল হয়। বাঁধ মানে না দু’চোখের জল। তোমার কথা মনে হতেই শ্রাবণের বারিধারার মতো অবিরাম ঝরে পড়ে দু’চোখের জল। তোমাকে হারানোর গভীর শোকে নিঃশেষিত আমি পৃথিবীর বুকে। এতো কষ্ট আমার সহ্য হয় না গো ! আমি আর পারছি না রে জান ! মনে হচ্ছে পরাণ পাখিটা দেহ থেকে উড়াল দিয়ে চলে যাবে। কতো খুঁজেছি তোমায়। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি তোমায়। ভেবে ছিলাম অভিমান ভুলে একদিন  তুমি ফিরে আসবে। তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু কভুও তুমি এলে না। সত্যি সত্যি ভুলে গেছো আমাকে। খব সহজেই ভুলে গেছো। কখনো জানা ছিলো না আমাকে তুমি এমন ধোঁকা দিবে। তোমাকে বিশ্বাস করে অনেক বেশি ভালোবেসে ছিলাম। আমার সহজ সরল জীবনে তোমাকে জড়িয়ে ছিলাম। তোমার মাঝে আমি বেঁচে থাকার মন্ত্র খুঁজে পেয়েছিলাম৷ কিন্তু এসব কিছু আমার ভুল ছিলো। ভুল ছিলো তোমাকে বুকে টেনে নেওয়া। যদি জানতাম তুমি এমন করবে, তবে ভুল করেও তোমার ভালোবাসায় সাড়া দিতাম না। আমাকে তুমি কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে দিলে। বিনা দোষে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে। জানিনা এতে তুমি কি এমন সুখ পেলে ! মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করে আমাকে তুমি ধোঁকা দিলে। আমার জীবন নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেললে। আমিতো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। কখনো তোমাকে আঘাত দেইনি। সবসময় চেয়েছি তোমাকে হাসি-খুশি রাখতে৷ তবুও তুমি আমাকে কষ্ট দিতে ভুল করলে না। ভালোবাসার প্রতিদানে নোনা জলে ভাসালে। নিজেকে আড়ালে করে আমাকে নিঃস্ব করে দিলে। কেড়ে নিলে যাপিত সুখ। খুব বেশি চাওয়ার ছিলো না তোমার কাছে। তোমার থেকে পাওয়া একটু সুখেই বাঁচতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর বুকে। আমাকে কষ্ট দিয়েই যদি তুমি সুখী হয়ে থাকো তাহলে আর ফিরে চাই না তোমাকে। কোনো অভিশাপও দিবো না। আমিও চাই তুমি সুখে থাকো। যতো কষ্ট আমার হোক। তোমাকে হারানোর শোকে নিঃশেষ হয়ে যাবো তবুও তোমার জন্য আর অপেক্ষায় থাকবো না আমি। যেখানে আছো ভালো থাকো তুমি। একদিন আমিও ভুলে যাবো তোমাকে। তবে আমি স্বার্থপর নই। তোমাকে আমি মন থেকেই ভালোবেসে ছিলাম। আমার ভালোবাসাকে কখনো অমর্যাদা করতে পারবো না। তাই মনে মনে দূর থেকেই তোমাকে ভালোবেসে যাবো। তোমার সাথে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না আমার। এক বুক কষ্ট নিয়ে খুব শীঘ্রই আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। কখনো আর মাতৃভূমিতে ফিরে আসবো না। মনের মধ্যে অনেক অভিমান নিয়ে চলে যাবো দূর প্রবাসে। জানিনা সেখানে আমি কেমনে থাকবো। তোমার কথা হয়তো সেখানেও খুব মনে পড়বে। খুব মন চাইবে তোমাকে এক নজর দেখতে। কিন্তু দেখতে পাবো না। তোমার সাথে হাজার জনমের ব্যবধান সৃষ্টি হলো। আমি চলে যাবো অচিন দেশে। সেখানে কাজের ফাঁকে তোমাকে অনেক মিস করবো। তোমার ছবি আমার দু’চোখে ভাসবে। ভেতর থেকে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে৷ আর লিখতে পারছি না। হাতে কোনো শক্তি পাচ্ছি না। অনুভূতি ঝাপসা হয়ে আসছে। ভাবনাও কাজ করছে না। সবকিছু আজ নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেনোকিছুই নিজের অনুকূলে নেই। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। এই গল্পটি যেদিন পত্রিকার পাতায় অথবা কোনো গল্পের বইতে পড়তে যাবে জানিনা তোমার কেমন লাগবে। মনের সবটুকু অভিমান থেকে লেখা এই গল্পটি যদি তোমার মনে এতোটুকু দাগ কেটে যায় নিজেকে অনেক সার্থক মনে করবো। মনে করবো তোমাকে কাছে না পেলেও তোমার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে লেখক হওয়ার বাসনা জেগেছিলো মনে। গল্পের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে নিও। গল্পের পাতায় আমাকে খুঁজে পাবে। আজ আর নয়। ভাবনা আর কাজ করছে না। আর একটা শব্দও আসছে না ভিতর থেকে। তুমি ভালো থেকো অভিমানী অন্যের ভালো থাকায়। আমি চলে গেলাম দূর প্রবাস জীবনে। কখনো আর ফেরা আসবো না। মরে গেলে সেখানেই লাশ হয়ে পড়ে থাকবো। তবুও এই মুখ আর কোনোদিন তোমাকে দেখাবো না। চোখের জলে তোমাকে বিদায় জানালাম। আমাকে তুমি ক্ষমার দৃষ্টিতে রেখো। যমুনার ঘোলা জলে তোমার আমার যাপিত স্মৃতি ডুবিয়ে তোমার দৃষ্টির আরণ্যক থেকে চিরতরে আমিও আড়ালে চলে গেলাম। আর কখনো তোমার মুখোমুখি হবো না। কখনো দাঁড়াবো না তোমার সামনে। তোমার পথের বিপরীত অভিমুখে চলে গেলাম নিঃসঙ্গতার চাদর জড়িয়ে। বিদায় অনুরাগী, চির বিদায়…!

Related Articles

Back to top button