গল্প

চাঁদের জোছনায় তোমাকে খুঁজি – জাকির আলম

ব্লাক-আউটের রাত। ঝিঁঝিপোকার বিশ্রী শব্দে বিরক্তির মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। দু’চোখে ঘুম নেই। দূরের মাঠ থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের হাঁক। দখিনা শীতল বাতাস থেকে থেকে জানালায় কড়া নাড়ছে। গভীর ঘুমে পৃথিবী নিমগ্ন। ক্রমশ রাত গভীর হচ্ছে। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায় কাতরাচ্ছি আমি। এমন সময় নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে একের পর এক ধূমপান করে যাচ্ছি। তবুও যেন থামছে না একাকিত্বের অস্থিরতা। ঘন ঘন নিঃশ্বাসে ভিতর থেকে ধমনীর অস্থিমজ্জা বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। শরীর থেকে প্রাণ যায় যায় অবস্থ। এমন সময় নিজেকে মৃত্যু পথযাত্রী মনে হচ্ছে। তবুও তোমাকে ভুলতে পারছি না। তোমার কথা মনে পড়তেই দু’চোখ থেকে শ্রাবণ মেঘের বারিধারার মতো অঝোরধারায় নোনা জল বয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের টানে। জীবন থেকে তোমাকে হারানোর বেদনা কোনো কালেই আমার শেষ হবে না। দেহের সমস্ত আবেগ অনুভূতি দিয়ে তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ছিলাম। কখনোই তোমাকে হারাতে চাইনি আমি। চেয়েছিলাম তোমার সাথে মধ্যবিত্ত একটা জীবন কাটাতে। স্বপ্নের মতোই সুন্দর হবে আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম। সেই স্বপ্ন আজ হাতুড়ি পিটায় ভাবনার দোরগোড়ায়। হঠাৎ একদিন চলে গেলে আমাকে নিঃসঙ্গ করে বহুদূর। জীবনের সমস্ত ভালোবাসার অনুভূতি থেকে তোমাকে কাছে পেতে চেয়েছিলাম। এর বেশি কিছু চাওয়ার ছিলো না এক জীবনে। মনের মধ্যে শুধু তোমাকে কাছে পাওয়ার দৃঢ় বিশ্বাসে বাঁধতে চেয়েছিলাম চিলেকোঠার ঘর। অনায়াসে ডুবতে চেয়েছিলাম তোমার রেশমি চুলের মেঘ অম্বরে। তোমার উৎফুল্ল মায়াবী হাসির ব্যগ্রতায় হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম স্বর্ণালি গাঙচিলের দেশে। ভীষণ ভালোবাসায় তোমাকে জড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর বুকে। তুমি আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনি ছিলে। তোমাকে ছাড়া কখনোই নিজেকে কল্পনা করতে পারিনি। আমার বেঁচে থাকাটাই ছিলো তুমি কেন্দ্রিক। তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকে কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে পারিনি। পারিনি তুমিহীন এক পলক বেঁচে থাকতে। একদিন তোমাকে না দেখলে দৃষ্টির জলে নদী হয়ে যেত। মনে পড়ে প্রতিদিন তোমার সুন্দর রূপের প্রশংসা করে একটি করে কবিতা লিখতাম। তুমি সেই কবিতাগুলো ভীষণ উৎসাহে পাঠ করতে। তোমাকে নিয়ে লেখা সেইসব কবিতা আজ বেদনার অগ্নিশিখা হয়ে  বারংবার আমাকে পুড়িয়ে মারে। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে তোমার চলে যাওয়া আজো মানতে পারিনি আমি। তোমাকে হারানোর কষ্টে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমার বেঁচে থাকাটা আজ ভীষণ দায় হয়ে পড়েছে। প্রতিটি রাত মির্ঘুম কাটতে কাটতে চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। দৃষ্টি শক্তি কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। সম্মুখের পৃথিবী আজ ঝাপসা লাগে। মোটা ফ্রেমের হাজার পাওয়ারের চশমাতেও স্পষ্ট দেখিনা প্রকৃতির নান্দনিকতা। উচ্ছল আনন্দে আর আগের মতো হাসতে পারিনা মনের সুখে। সবকিছু আজ বিষাদে ঢেকে গেছে। হাসতে গেলেই মন খারাপের কালো মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে যায় হাসির ফোয়ারা। অবশ দেহে আজ বাসা বেঁধেছে নিঃসঙ্গতার পরিযায়ী পাখি। সবুজ পৃথিবীর দৃষ্টি নন্দন কারুকার্যে কৌতূহল জাগে না ভঙ্গুরিত মনে। সবকিছুর প্রতি আজ বেদম অনীহা। কোনোকিছুতেই মন স্থির হয় না তোমাকে হারানোর শোকে। নিজের প্রতি আজ চরম অবহেলা। আহারের প্রতিও বড্ড অনীহা। শারীরিক এবং জৈবিক চাহিদার শক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। ভালো লাগেনা এমন অভিশপ্ত জীবন। যেদিকে তাকাই  শুধু মহা শূন্যতার হাতছানি। বিষাদ মনে দিগ্বিদিক ছুটে চলি মনের অগোচরে। ক্ষণকালের জীবনে এতোটা কষ্ট পাবো কোনোদিন জানা ছিলো না। আগে জানলে গলা টিপে হত্যা করতাম এমন অভিশপ্ত জীবন। জানিনা কোন পাপের বিনিময়ে এমন জীবন উপহার পেয়েছি প্রকৃতির কাছ থেকে। তুমি যদি একটি বারের জন্যেও উপলব্ধি করতে তোমাকে ছাড়া আমি কতোটা বেশি অসহায় তাহলে কোনোদিন তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারতে না। পৃথিবীর সব ভালোবাসার  বিমিময়েও তোমাকে আমি ধরতে রাখতে পারিনি। কখনোই থাকতে চাওনি তুমি। সারাক্ষণ শুধু চলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে আমার সাথে পায়চারি করতে। কখনো বুঝতে পারিনি সত্যি সত্যি একদিন চলে যাবে আমার জীবন থেকে। পবিত্র মনে ভালোবেসেও আজ আমি তোমার কাছে অপরাধী বলে পরিগনিত হয়েছি। কখনো আমি তোমার প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারিনি। তোমার প্রয়োজনে আমাকে তুমি চরমমাত্রায় ব্যবহার করেছো। মিথ্যে প্রেমের ধোঁকায় আমাকে তুমি ফাঁকি দিয়েছো। উদ্দেশ্য প্রণোদিত অজুহাতে প্রতিনিয়ত আমাকে  তুমি বোকা বানিয়েছো। কখনো চাওনি আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে। চেয়েছো শুধু আমাকে ধোঁকা দিয়ে বহুদূরে চলে যেতে। আমাকে আঘাত দিয়ে সত্যি যদি তুমি সুখী হয়ে থাকো সেখানে আমার কিছু বলার নেই। তোমার ভালো থাকাটাই যে আমার কাম্য। ক্ষণকালের জীবনে তোমাকে কোনো অভিশাপ দিবো না। এক বুক কষ্ট নিয়ে একদিন আমিও চলে যাবো না ফেরার দেশে। সেদিন আর অপেক্ষায় থাকবো না তোমার। অনন্তকালের তরে সেদিন  নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। ফেরারি পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যাবো অসীম আকাশে। তবুও তোমাকে কাছে না পাওয়ার আক্ষেপ থেকে যাবে অনন্তকাল। তোমার ফেরার অপেক্ষায় থেকে পায়ের তলে শিকড় গজাবে তবুও মগ্ন থেকে যাবে চৈতন্য শরীর। তোমাকে কাছে পেতে মগ্ন হওয়া আমি পথ চেয়ে রবো পাতা ঝরা আঁকাবাঁকা পথেরধারে। বিরহের গান গেয়ে আনমনে হেঁটে যাবো তেপান্তের ধূলি গায়ে মেখে। এক জীবনে তোমাকে না পাওয়ার কষ্টে জরাগ্রস্ত হতে হতে মিলিয়ে যাবো শূন্যতার আবডালে তবুও আকুল হৃদয় তোমাকে পাওয়ার আশায় মিথ্যে স্বপ্নে গা ভাসাবো সাগর-নদীর জলের বুকে। অতিমাত্রায় তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছি জীবনের আয়ু ফুরিয়ে না যেতেই। আফসোসের বদলে তোমাকে ভালোবাসতে পারার আনন্দে অবশান্য দেহের কোথায় যেন কিঞ্চিৎ সুখের আবহ খুঁজে পাই। মনে প্রাণে তোমাকে ভালোবাসতে পারাটাই আমার পরম সুখ। আমার অস্তিত্বের প্রতিটি পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তোমার নাম। যেদিন আমি বিলীন হয়ে যাবো পৃথিবীর বুক থেকে সেদিনো তোমার মায়ায় জড়িয়ে  উড়ন্ত চুমু খাবো সমীরের আলিঙ্গনে। এক বুক আশা নিয়ে মনের মধ্যে যে স্বপ্ন এঁকে ছিলাম, সেই স্বপ্নের পথ ধরে তোমাকে মুক্ত করে দিবো অবারিত আকাশে। তোমার উড়ে চলার আনন্দে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবো উন্মত্ত মনে। বিষাদের সুর ছড়িয়ে তোমার ভাবনায় বিভোর থেকে হঠাৎ একদিন ঝরে যাবো প্রকৃতির বুক থেকে। তোমার চির সুখের পৃথিবীতে রেখাপাত করতে যাবো না বে-শরম মনের অবর্তমানে। তোমাকে ভালোবাসি এই বিশ্বাসটুকু তোমার কাছে স্থাপন করতে পারলেই মরেও সুখ পাবো আমি। কোনো কালে ভেবো না প্রতারক কোনো প্রেমিকের মতো আমিও তোমাকে মিথ্যে প্রেমের জালে ফেলে সবকিছু লুটিয়ে নিতে এসেছি। একশত ভাগ বিশুদ্ধ প্রেমের সমন্বয়ে তোমাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। তারপরও অবশেষে আমি তোমার বিশ্বাসের বলি হলাম। ভুল করেও আমার ভালোবাসাকে তুমি পরখ করে দেখোনি কোনোদিন। এইটুকু আফসোস জনম জনম থেকে যাবে তোমার প্রতি। বারংবার তোমার প্রিয়জন হতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি শোচনীয় ভাবে। এক জীবনে তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে অপরাধী হয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী থেকে গেলাম তোমার আদালতে। সেখানে তুমি যেই শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো পরম সোৎসাহে। তবুও আমাকে তুমি বিভাজন করে দিওনা তোমার পৃথিবী থেকে। দূর থেকেই মনে রেখো আমাকে তুমি। জানি এই জীবনে আর কোনোদিন তোমাকে পাবো না আমি। তোমার আমার পথের দূরত্ব আজ আকাশ-পাতাল সমপরিমাণ। তবুও তোমাকে ভালোবাসি দুর্বার গতিতে তেজোদ্দীপ্ত জৈবিক শক্তির উত্তেজনায়। আমার পৃথিবীর সব রং ম্লান করে দিয়ে যেখানে আছো ভালো থেকো স্বর্গীয় সুখেরধারায়। এখনো বিষাদ মনে নিঃসঙ্গ রাতের গভীর নিশীথে দূরের আকাশ পানে তাকিয়ে চাঁদের জোছনায় তোমাকে খুঁজি এক বুক ভালোবাসার আলতো পরশে। তোমাকে হারিয়ে ভালো নেই আমি, সত্যি ভালো নেই। জরাগ্রস্ত জীবনের প্রতিটি রাত এখন ব্লাক-আউটের অন্ধকারে কাটিয়ে দেই ধূমপান আর মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে। এই নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে হাতে তুলে নিয়েছি অন্ধকার জগৎ। অতিরিক্ত ধূমপানের ক্ষতিকর বিষাক্ত ছোবলে ক্রমান্বয়ে মিলিয়ে যাচ্ছি আমি শূন্যতার প্রতিধ্বনিতে। তবুও আপাদমস্তক ভালোবাসার তৃষ্ণায় আজন্ম  তৃষিত আমি ভাবনায় ডুবে থেকে ভরা চাঁদের জোছনায় তোমাকে খুঁজি।

Related Articles

Back to top button