প্রবন্ধ

কমিউনিকেশনের হাতেখড়ি

আসিফ খন্দকার - সম্পাদক, কালিহাতীর সাহিত্যাঙ্গন

আপনারা যারা আমার পাঠকদের মধ্যে তরুণ তরুণী আছেন তারা পথে-ঘাটে, জলে-জঙ্গলে, সমতল ভূমি কিংবা পাহাড়ের চুড়ায় গিয়েও ইদানীং  যে শব্দটির গুঞ্জন শুনতে পান তা হলো ‘স্কিল’। আপনাদের সময়ে সবাই এখন এই স্কিল ডেভেলপ করার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। আর স্কিলের প্রসঙ্গ এলে একেবারেই উপরের দিকে রয়েছে ‘কমিউনিকেশন স্কিল’। তো আসুন কমিউনিকেশন নিয়ে কিছু কথা বলি। লেখাটি তুলনামূলক ভাবে বড় তবে যে বিষয়ে লিখছি এই বিষয়ের উপর প্রত্যেক ভাষায় রচিত অনেক বই বাজারে আছে সেই বিবেচনায় একটি লেখায় সম্পূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুপাতে লেখাটি ছোটো বলেই আমি বিবেচনা করছি।
প্রথমে, কমিউনিকেশন কি তা আপনাকে বুঝতে হবে।কমিউনিকেশন মানে হচ্ছে যোগাযোগ। কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করতে আপনারা অনেকেই ইতিমধ্যে অনেক বই পড়ে ফেলেছেন।
লেইল লোনডেস এর লেখা হাউ টু টক টু এনিওয়ান, ল্যারি কিং এর লেখা কিভাবে কথা বলবেন অথবা আমাদের আয়মান সাদিক ভাইয়ের লেখা কমিউনিকেশন হ্যাকস ইত্যাদি বই বেশ আলোচিত। এই বইগুলি সহ কমিউনিকেশনের উপরে অনেক বই পড়া পাশাপাশি বিভিন্ন  ভিডিও আমার দেখা হয়ে গেছে। এসবে একটি বিষয় যা আমাকে চিন্তিত করে তা হচ্ছে এখানে আপনাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমিউনিকেশন এর নানাবিধ উপায় শেখানো হয়।তবে সার্বিক কমিউনিকেশন এর ব্যাপারে তেমন একটা আলোকপাত নেই।
বিস্তারিত আলোচনার আগে আপনাদের একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলতে চাই।কমিউনিকেশন, মার্কেটিং,সেলস এই তিনটি বিষয় কিন্তু একই না। পার্থক্য অনেক। কমিউনিকেশন হচ্ছে যোগাযোগ, মার্কেটিং হলো প্রচার এবং সেলস হচ্ছে বিক্রয়। এই তিনটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গেলে লেখা আরও দীর্ঘায়িত হয়ে যায় বলে করছি না।আপনারা গুগলে সার্চ করলে অনেক আর্টিকেল পেয়ে যাবেন।আমি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। ধরলাম আপনার নাম রফিক।আপনি আপনার বন্ধু শফিক কে বললেন যে শাওমির নতুন ফোনটা ব্যবহার করে আপনি বেশ সন্তুষ্ট। শফিক সাহেব আপনার কথাটি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করলেন এবং পরবর্তী তে তার পরিবারের জন্য সেই ফোনটি ক্রয় করলেন। এখানে এইযে শফিক সাহেব আপনার কথাটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন এবং প্রভাবিত হয়ে কাজ করলেন এটাই কমিউনিকেশন।
এই একই গল্পে মার্কেটিং হলো আপনি শফিক সাহেব কে শাওমি ফোনের নতুন ফিচার, সুবিধা, এর গুণাবলী ব্যাখ্যা করলেন।এতেকরে শফিক সাহেব ফোনটি কিনতে পারেন।এখানে আপনার থেকে ফোনটির গুণাবলী তাকে বেশি প্রভাবিত করবে।
আর সেলস হলো আপনি শফিক সাহেবের প্রয়োজন উপলব্ধি করে ক্ষেত্রবিশেষ প্রয়োজনের সৃষ্টি করে শফিক সাহেব কে বুঝাবেন যে এই ফোন কিনলে সে কিভাবে লাভবান হবে।শফিক সাহেব নিজের লাভের কথা ভেবে ফোনটি কিনলেন।না এখানে আপনার প্রভাব কাজ করেছে আর না ফোনের গুণাবলী।এখানে শফিক সাহেব তার নিজের প্রয়োজন দ্বারা প্রভাবিত।
তাহলে, উপরে উল্লেখিত বইগুলো বা কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ এর বিভিন্ন ভিডিও আপনাকে মার্কেটিং এবং সেলস এর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি শেখালেও কমিউনিকেশনের প্রথম ক্যাটাগরি বা ব্যক্তিজীবনে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের স্কিল ডেভেলপ এর দিকটা এড়িয়ে যায়।
এখন বলবো কি কি উপায়ে আপনি কমিউনিকেশন রক্ষা করতে পারেন।এর বেসিক উপায় তিনটি।
প্রথমত, যদি আপনি নিজে উল্লেখযোগ্য সফল হন,দ্বিতীয়ত ভয় সৃষ্টির মাধ্যমে,এবং তৃতীয়ত ‘ ভুলিতে দিবো না’ উপায় অবলম্বন করে।
•প্রথমে বলেছি যদি আপনি উল্লেখযোগ্য সফল হন তাহলে আপনার কমিউনিকেশন স্কিলও উন্নত হয়ে যাবে। তখন আপনি কারো সাথে যোগাযোগ রাখেন বা না রাখেন সবাই আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবে এবং আপনাকে মনে রাখবে। হোক সেটা সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় অথবা আপনার সাথে তার সম্পর্কের দিকটি উল্লেখ করে নিজস্ব গন্ডিতে স্বল্প পরিসরে বিস্তার লাভের লোভে।
এখানে উল্লেখযোগ্য সফল বলতে বোঝানো হয়েছে এমন একটি পর্যায় যা মানুষ উল্লেখ করতে পারে। জনপ্রিয় নায়ক,গায়ক,খেলোয়াড় অথবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুনামধারী ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত। জনপ্রিয় এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই।কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুনামধারী ব্যক্তি হচ্ছে আপনি যে কাজে নিয়োজিত সেখানে অন্যদের তুলনায় আপনার বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।যেমন একজন চিকিৎসক। শুধু এটুকু পরিচয় কাওকে এই ক্যাটাগরিতে বিবেচনার জন্য যথেষ্ট নয়।তবে অমুক চিকিৎসক নাক-কান-গলার শ্রেষ্ঠ সার্জন এখানে এইযে নাক-কান-গলার এত চিকিৎসকদের মধ্যে উনার দক্ষতার সুনাম হচ্ছে ইনিই হলেন কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুনামধারী ব্যক্তি।
•ভয় সৃষ্টির মাধ্যমেও কমিউনিকেশন রক্ষা করা যায়।যদিও এটাকে আমি উৎসাহ দিচ্ছিনা তবে এটাও ঠিক, যে কেও চাইলেই এই ক্যাটাগরিতে আসতে পারবে না। বুঝিয়ে বলি। আপনাদের বন্ধুমহলে দু একজন বন্ধুবান্ধব আছে না যাদের কে আপনারা ঠোঁট কাটা,মুখ ফোড়া অথবা শুদ্ধ ভাষায় স্পষ্টভাষী বলেন? এই মানুষ গুলোকে কিন্তু কমবেশি সবাই ভয় করে। এই ভয়ের কারণেই তাদের কমিউনিকেশন রক্ষা হয়ে যায়। যেমন আপনি স্কুল থেকে পাশ করে যাবার পরে বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ না রাখলেও কিন্তু ওই বন্ধুর সাথে ঠিকই রাখেন যারসাথে পরবর্তী তে দেখা হলে সে ‘কিরে নবাবের বংশধর’ ( নিজেদের পরিচিত মহল অনুযায়ী কল্পনা করে নেন) জাতীয় সম্বোধন করে আপনাকে অপ্রস্তুত করতে পারে।
এই অপ্রস্তুত হবার ভয়ে হলেও আপনি তারসাথে যোগাযোগ রাখবেন যাতেকরে তার কমিউনিকেশন রক্ষা হয়ে যাবে।
 •এখন যে উপায় বলবো এটা সবথেকে সহজ,এবং বেশিরভাগ মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এর নাম আমি দিয়েছি ‘ভুলিতে দিবো না’। এরমানে আপনি সবার সাথে সৌজন্যমুলক যোগাযোগ রক্ষা করবেন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে। জন্মদিন, ঈদ, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও মাস-দু’মাসে বন্ধু বা পরিচিতজনদের খোঁজ নেয়া,সুযোগ হলে তাদের সাথে দেখা করা,অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেয়া ইত্যাদি চালিয়ে গেলে আপনি সবার নজরে থাকবেন এবং আপনাকে কেও ভুলতে পারবে না। তারা আপনার থেকে কিছু পাওয়া অথবা ভয় ছাড়াই আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবে যেহেতু আপনি রেখেছেন। এভাবে একটি সুন্দর কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ হয়ে যাবে আপনার। এখানে উল্লেখ্য যোগাযোগ রাখতে হবে সীমাবদ্ধতা বুঝে। আপনি বন্ধুর বাচ্চার পরীক্ষার জন্য শুভ কামনা জানাবেন।কিন্তু বন্ধুর বাচ্চা কেনো গোল্ডেন এ প্লাস না পেয়ে শুধু এ প্লাস পেল,কোন বিষয়ের জন্য তার গোল্ডেন পাওয়া হয়নি এবং সেই বিষয়ে কিভাবে ভালো করতে হবে এর উপরে একটা লেকচার দিয়ে ভাববেন না আপনার কমিউনিকেশন স্কিল ব্যাপক ভালো। এরকম হলে আপনি বাচাল হিসেবে পরিচিত হবেন এবং তখন আপনার সাথে মানুষ যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে বিরক্তির কারণে।
এই তিনটি উপায়ে আপনি ব্যক্তিজীবনে কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করতে পারবেন।
কেন এই কমিউনিকেশন টি প্রয়োজন সেই প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলি।
★রাজনীতির উপরে কালজয়ী বইয়ের কথা বলতে গেলে এরিস্টটলের পলেটিক্স এর পরেই আসবে মেকিয়াভেলির ১৫১২ তে লেখা ‘দ্যা প্রিন্স’ বইটির কথা। এই বইতে মেকিয়াভেলি সমাজের মানুষ কে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। ~কিংমেকার,কিং,ওয়ার্কার,ফলোয়ার,সিইর।•কিংমেকার তারা যারা সমাজ পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণ করে।
•সমাজ পরিচালকদেরকেই বলা হয়েছে কিং। •কিংদের কথায় যারা কাজ করে তারা ওয়ার্কার।
•কিংদের মতাদর্শ যারা অনুসরণ করে তারা ফলোয়ার।
•এসব মানুষদের দ্বারা প্রভাবিত সমাজে সৃষ্ট গতানুগতিক নিয়ম অনুসরণ করে চলা মানুষ রা হলো সিইর( seer) যার মানে দর্শক।
এখানে সমাজের কোন শ্রেণীতে আপনি থাকবেন এবং যে শ্রেণীতেই থাকুন সেখানে সুষ্ঠু জীবন যাপনের জন্য আপনার কমিউনিকেশন স্কিলের বড় প্রভাব থাকবে।প্রচলিত কমিউনিকেশনের বইগুলিতে আপনাকে কিভাবে একটি সুন্দর ই-মেইল লেখা যায় এটা শেখানো হলেও কিভাবে ই-মেইল টি গ্রহীতার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে তা শেখানো হয় না।এরজন্য প্রয়োজন ব্যক্তিজীবনের কমিউনিকেশন স্কিল। আপনি যত সুন্দর করে মেইলই লিখুন না কেন আপনার যে বন্ধু টপার,যে নেতা এবং যে স্যারের সাথে একটি সুন্দর যোগাযোগ রক্ষা করে চলে (আমার বর্ণিত তিন ক্যাটাগরি) তাদের দেয়া মেইলের থেকে কম গুরুত্ব পাবে। সুন্দর করে মেইল লিখাটা যেমন শিখতে হবে তেমনই শিখতে হবে মেইলটির গুরুত্ব বৃদ্ধির কৌশল গুলিও।
এখন আরেকটি বিষয় বলে শেষ করবো। স্টেজ পারফর্ম করার সময় অডিয়েন্সদের সাথে কমিউনিকেশনের একটু বেসিক বলি।
স্টেজে পারফর্ম এর সময় অডিয়েন্স মধ্যে আলোচ্য বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে নেয়া আবশ্যক যাতে তারা আপনার আলোচনা বা আপনার পারফরম্যান্সে মনোযোগী হয়।
আপনি দুভাবে অডিয়েন্স এর সাথে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন। নিজেকে উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে, অথবা নিজেকে অতি সাধারণ করে তুলে।
ইন্ডিয়ার কাপিল শারমা,জাকির খান অথবা আমাদের দেশের রাফসান শাবাব ইনারা দ্বিতীয় টি অবলম্বন করেন। আবার আনুভাব বাসসি, খালিদ ফারহান, আমি আমরা প্রথম পদ্ধতি টি অনুসরণ করি।
নিজেকে উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে মানে আপনি অডিয়েন্স এর মধ্যে প্রথমেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন যারফলে তাদের মাঝে আপনার কথা শোনার আগ্রহ জন্মাবে।এটা আপনি তৎক্ষনাৎ কোনো চমকপ্রদ কথার মাধ্যমেও করতে পারেন অথবা আপনার পূর্ববর্তী কাজের কথা উল্লেখ করে দুভাবেই করতে পারেন।
আর নিজেকে অতি সাধারণ করে তুলে মানে আপনাকে অডিয়েন্সদের সাথে সামঞ্জস্যতা অথবা তাদের আবেগ বা করুণা অর্জন করে মনোযোগ আকর্ষণ করে নিতে হবে। যেমন রাফসান শাবাব একটি শো তে বলেছিলেন ছোটোবেলায় একবার হারিয়ে যাওয়ায় তার মা তাকে খুঁজতে বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে যে আমার ছেলেটা মোটা,কালো। এই কথাটি অডিয়েন্সদের মধ্যে দুরকম প্রভাব বিস্তার করেছে।কেও ভাবছে যাক,আমি ফকির হই তবে কালো আর মোটা তো না( নো অফেন্স,আমি বোঝানোর জন্য লিখছি।আমি জাজমেন্টাল না যারা আমার আগের লেখা পড়েছেন তারা জানেন)। এই মানুষ গুলো আত্মতুষ্টি পেয়ে প্রভাবিত হয়েছে। আবার কেও ভাবছে যে আমি কালো মোটা বলে হীনমন্যতায় ভুগী, আমি তো একা না।সে সামঞ্জস্যতা পেয়ে প্রভাবিত হয়েছে।কাপিল শারমা নিজেকে গরীব বলে,জাকির খান নিজেকে কালো বলে ইত্যাদি ভাবে এই পদ্ধতির দ্বারা চমৎকার  পারফর্ম করে যাচ্ছেন।স্টেজে  কান্না করে অথবা মানুষের স্বভাবজাত আবেগ উৎপন্নকারী উপস্থাপনের দ্বারাও মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়।পদ্ধতি যেটাই হোক, অডিয়েন্স এর মনোযোগ পাওয়াটাই স্টেজ পারফর্ম এর মূখ্য বিষয়।
শুরু থেকে উল্লেখিত প্রত্যেকটি বিষয়েই আরও বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ ছিলো তবে আমি লেখাটি সংক্ষেপনের উদ্দেশ্যে তা এড়িয়ে গিয়েছি।
কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে khondokarpavel211@gmail.com এড্রেসে আমাকে জানাতে পারবেন।

Related Articles

Back to top button