আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ইমাম মেহেদীর জন্মদিন। ১৯৮৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঐতিহ্যবাহী কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তায়জাল হোসেন ও মা মিসেস মনোয়ারা খাতুনের মধ্যে মেহেদী সবার ছোট। শৈশব ও কৈশর কাটে নিজ গ্রামে, বাড়ির পাশেই সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, খাল, মাঠ, ছোট্ট সেই চিরচেনা কৃষ্ণপুর বাজারে। কুষ্ণপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণপুর সোনলী সংঘ পাঠাগারের বই পড়া, খেলাধুলা ও বিনোদনের মাধ্যমে কৈশর পার করেছেন। বাড়ি থেকে দু কিলোমিটার দূরে ঐতিহ্যবাহী গড়াই নদী। পিতা
তায়জাল হোসেনও একজন বাউল শিল্পী, সংসার ও পেশার বাইরে তিনি বাউল গান করেন। মা মনোয়ারা খাতুন একজন গৃহিণী।
২০১১ সালে স্নাতক ও ২০১২ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন একই কলেজ থেকে। ২০১৫ সালে তথ্যমন্ত্রণালয়ের জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট থেকে বেতার ও টেলিভিশন সাংবাদিকতায় সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগ থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর এর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র থেকে ২০২০ সালে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা শেষ করেন। বর্তমানে ইমাম মেহেদী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল গবেষণারত।
ইমাম মেহেদী একজন তরুণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। অবহেলিত, উপেক্ষিত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনী সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁদের জীবনের গল্প শুনে অত্যন্ত খারাপ লেগেছে। অনেক সময় তাঁদের জীবনের কষ্ট দেখেশুনে চোখে জল এসেছে। আবার ভালো লেগেছে, যখন বীর যোদ্ধাদের বিজয়ের গল্প শুনেছি একান্ত মুহূর্তে অত্যন্ত কাছ থেকে হাসিমাখা মুখ থেকে। বিজয়ের ৪৭ বছর পর শহীদ ইকবালের ছবি উদ্ধার করাটা যেমন একটি ইতিহাস, ঠিক তেমনি ৪৭ বছর বিধবা লুৎফরের স্ত্রীর মুখ ও মনের কথা আরো বেদনাময়। যে কষ্টের কথা সহ্য করবার মতো না। ভাবলে শরীরের লোম খাড়া হয়। শুনলে চোখে জল আসে।” ( সংগ্রহ : ইমাম মেহেদী, বই ‘১৯৭১ ডাঁশার চাষী ক্লাব যুদ্ধ’ পৃঃ ১০)
পারিবারিকভাবেই ইমাম মেহেদীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। তার লেখার মধ্যে প্রমাণ পাওয়া যায়।
“আমার নানির কাছে যদি আমার মায়ের বয়স জিজ্ঞেস করি, তাহলে আমার নানি বলেন-তোর মাকে সাত মাসের কোলে করে শেখ সাহেবরে ভোট দিতি গিছলাম, স্বাধীনের আগের বছর। তাহলে এটা অনুমেয় যে, সেটা ছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন। আমার বয়স এখন তিরিশ বছর। সুতরাং আমার মায়ের পক্ষেও মুক্তিযুদ্ধ দেখা সম্ভব হয়নি। বাঙালির ইতিহাস, মৌখিক মুক্তিযুদ্ধের গল্প, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের গল্প, আর গণমাধ্যমে প্রচারিত-প্রকাশিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথার ইতিহাস আমাকে আবেগী করে তোলে। সেই আবেগী ভালোবাসা ও তারুণ্যের তারণা থেকেই ১৯৭১ সালে সূর্যোদয়ে কুষ্টিয়ার এই বীর নারীদের জীবনীগ্রন্থ আকারে প্রকাশের চেষ্টা।”–(সংগ্রহ : ইমাম মেহেদী, বই, ‘মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার নারী’ পৃ. ১২)
ছোট বেলা থেকেই সাহিত্য সংষ্কৃতির প্রতি ইমাম মেহেদীর ছিলো গভীর আগ্রহ। ২০০৪ সালে প্রথম পত্রিকায় ফিচার প্রকাশের মাধ্যমে লেখালেখির হাতেখড়ি। তারপর ২০০৮ সাল থেকে পুরোদমে সাংবাদিকতাকে পড়াশোনার পাশাপাশি নেশা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। এ সময় তিনি স্থানীয়, জাতীয় পত্রিকা, লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকাতে নিয়মিত লিখতে থাকেন। স্নাতক শ্রেণিকে অধ্যায়নকালে তার সম্পাদনায় কৃষ্ণচূড়া নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় কয়েক বছর।
সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের সময় তিনি কুষ্টিয়াতে সংগঠক হিসেবে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুষ্টিয়া জেলার প্রয়াত কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহমেদের পরিচালনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জানো অনুষ্ঠানের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন ইমাম মেহেদী। পেশাগত জীবনে ২০১৬ সাল থেকে কয়েকবছর ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা বর্তমানে রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। অনন্যা ম্যাগাজিনের কন্ট্রিবউটর হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে তিনি ১৯৭১ গণহত্যা নির্যাতন ও আর্কাইভ জাদুঘরের অধীনে কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, বধ্যভূমি জরিপের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ:- ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু’, ‘শতবের্ষ বঙ্গবন্ধুর যত অলংকার’,’বঙ্গবন্ধুর রোগ ও আরোগ্য’, ‘পল্লী গ্রামে বঙ্গবন্ধু’,’রবীন্দ্রনাথ ও যুদ্ধদিনে আমাদের জাতীয় সংগীত’, ‘হিটলারের লাইব্রেরিতে আমাদের রবীন্দ্রনাথ’, ‘নজরুলের মন ছুঁয়েছিলো কুমারখালী’, ‘কবি থাকলে আজ প্রতিবাদ করতেন’, ‘নারীর প্রেমে নজরুল’, ‘নজরুলের প্রেমিকারা’, ‘নির্ভীক সাংবাদিকতায় কবি নজরুল’,
‘ঢাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রবীন্দ্র-নজরুল মুখোমুখি’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি- লালন’, ‘সমাজ গঠনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার’,
‘সাইজি লালন ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদার’, ‘আমি কোথায় পাবো তারে গগন হরকরা’, ‘শক্তিমান শিল্পীর দুর্বল প্রস্থান-জগদ্বীশ গুপ্ত’, ‘আলো আধারের কবি আজিজুর রহমান’, ‘ইতিহাসে বিপ্লবী বাঘাযতিন’, ‘ইতিহাসের বাতিঘর মুনতাসীর মামুন’,
‘কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দীকা’, ‘আবুল মনসুর আহমদ জীবন ও কর্ম’, ‘বইমেলার পাদদেশের যত ইতিহাস’, ‘রক্ত বাড়ির ইতিহাস’, ‘সৈয়দ হক তাঁর গান’, ‘সেক্সুয়াল জেনোসাইড’ ইত্যাদি।
প্রকাশিত গল্প- ‘জীবনের গল্পে চারু’,’বালিকার হাসি’,
‘জীবনের গল্প’ ও ‘বউদিঃ।
তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :
‘লালন তীর্থের পঞ্চপথিক’-২০১৫, ‘কাদামাটি (কাব্যগ্রন্থ)’-২০১৮, ‘মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার নারী’-২০১৯, ‘১৯৭১ ডাঁশার চাষী ক্লাব’-২০১৯, ‘আলোর পথে (সম্পাদিত)’
-২০১৩, ‘কোহিনুর ভিলা গণহত্যা’-২০২০, ‘গোয়ালগ্রাম গণহত্যা’-২০২১ (প্রকাশিব্য,
আমার জীবনে কখনো প্রেম আসেনি-(২০২২)
২০১৯ সালে আবুল মনসুর আহমদ প্রবন্ধ পুরস্কার, ২০১৩ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় ‘বেস্ট ট্যোবাকো কন্ট্রল জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
লেখকঃ সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।