মাতৃতুল্য প্রিয় শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা
এস.এম.রাহমান জিকু শিক্ষার্থী, স্নাতক (সম্মান) ৪র্থ বর্ষ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।
আমার শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় কেটেছে গ্রামীণ জনপদ ঘিরে। ২০১০ সালে পিএসসি, ২০১৩ সালে জেএসসি, ২০১৬ সালে এসএসসি এবং ২০১৮ সালে এইচএসসি পাশের মধ্যে দিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য জনপদ ছেড়ে শহরে পাড়ি জমালাম।
অচেনা শহরে চারপাশটা কেবল অসহায়ত্বের হাহাকার বইছে। চারপাশের সবকিছুই যেন খুউপ অপরিচিত। এভাবেই কিছু সময় পেরিয়ে গেলো। শেষমেশ চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনে স্নাতক (সম্মান) ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে গেলাম।
সোমবার। ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮। সেদিন ছিল আমার অনার্স ১ম বর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। সেদিনের সকালে খুউপ ভোরে উঠে ফ্রেশ হয়ে উৎফুল্ল মনে কলেজে যাচ্ছি। কলেজের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছিলাম। হঠাৎ করেই আচমকা ঝড়ো হাওয়া বয়ে ঝুম বৃষ্টি নামলো। আমি কোনো মতে দৌড়ে কলেজের প্রধান ফটকের নিচে আশ্রয় নিলাম। এদিকে ঘড়ির কাটা ১০ টা পেরিয়ে ২০ মিনিটের পথে। কলেজের প্রধান ফটক থেকে আমার ডিপার্টমেন্ট হেঁটে দু’মিনিট। কিন্তু ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করে যাওয়া সাহস পেলাম না। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যে কলেজ প্রধান ফটকের গেইটে একটা সিএনজি হরণ বাজিয়ে উঠলো। তৎক্ষনাৎ গেইটের প্রহরী গেইট খুলে দিলো। সিএনজি কলেজের ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই ভেতর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে আমার কানে, এই বাবু শুনছো? এতোটা মিষ্টি করে আম্মুর কাছে শুনেছি আমাকে ডাকতে। আমি মুহূর্তেই দু’পা বাড়িয়ে সিএনজির পাশে গিয়ে বললাম, জ্বি বলুন। হঠাৎ মনে পড়লো প্রহরী ম্যাম বলে সালাম দিলো। আমি কিছুটা স্মিত স্বরে আবারও বললাম, আসসালামু আলাইকুম ম্যাম। জ্বি বলুন। ম্যাম বললেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম। কোন ক্লাসে তুমি? গেইটে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
আমি কিছুটা বিচলিত হয়ে বললাম, ম্যাম আমি সদ্য অনার্স ১ম বর্ষে এডমিশন নিয়েছি। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে যাচ্ছি। বৃষ্টির কারণে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ম্যাম পুনরায় বললেন, কোন ডিপার্টমেন্ট? বললাম, সমাজবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্ট ম্যাম। ম্যাম হেসে বললেন, সিএনজিতে উঠো। আমি মুহূর্তেই ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলাম। ম্যাম বললেন, ভেতরে বসো। ততক্ষণে সিএনজি ড্রাইভার সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নিচের গেইটে পৌঁছে গেলো। আর আমি কিছুটা ভয় পেয়েও আনন্দিত ছিলাম। কারণ ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ম্যাম সমাজবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক।
তারপর ম্যামের সাথে সিঁড়িতে উপরে উঠছিলাম। তখন বুঝতে পারছিলাম ম্যাম হয়তো অসুস্থ। ম্যামের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি ম্যামের ব্যাগ নিতে সাহায্য করতে চাইলে ম্যাম মৃদু হেসে বলেন, এই উঠে গেছি। আমাদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ছিলো ২য় ফ্লোরে। এভাবে সেদিন ম্যামের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ পেলাম।
কিছুক্ষণ পরপরই ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হয়ে গেলো। যদিও বৃষ্টি বিড়ম্বনায় ৪০ মিনিট দেরিতে ক্লাস শুরু হয়। ক্লাসের টিচার আসতেই চমকে উঠে সবার সাথে সালামে শরীক হলাম। আসসালামু আলাইকুম ম্যাম। কারণ যাঁর সাথে একটু আগে সিএনজিতে আসলাম, তিনিই ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের ম্যাম। ম্যামকে ক্লাসে দেখে কিছুটা ভালো লাগা কাজ করছিল, আবার এট্টু নার্ভাসও ছিলাম।
সেদিন আমাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের রুম নং ছিলো ২০২। আমি মাঝখানের সারিতে ২য় বেঞ্চে বসেছিলাম। ম্যামের দৃষ্টিতে চোখ পড়তেই আকস্মিক ভাবে নার্ভাস লাগার কারণটা বেড়ে যাচ্ছিল।
ম্যাম চেয়ারে বসলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, আমি খালেদা খানম। সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। তারপর আমাদের সাথে পরিচিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সবাই এক-এক করে পরিচয় দিতে লাগলো। আমিও পরিচয় দিতে দাঁড়ালাম। ম্যামের দিকে তাকাতেই মুখে শব্দ আটকে গেলো। ম্যাম বিষয়টি খেয়াল করলেন এবং চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, ভয় পেও না রিলাক্স হয়ে বলো। ততক্ষণে আমার বাকি সহপাঠীরা দাঁত দেখিয়ে হেসে দিলো। ম্যামের উৎসাহে আমি সংকোচহীন ভাবে পরিচয়টা দিতে সক্ষম হলাম।
ক্লাসে সেদিন ম্যামের কথাগুলোর মধ্যে দুয়েকটা বাক্য আমি নোট করে নিয়েছিলাম। যার মধ্যে আছে–
ক. জীবনে কারো লাভ করতে না পারলেও ক্ষতি করবে না।
খ. নিয়মিত পরিশ্রম মানুষের ভাগ্যের পরির্তন করতে সক্ষম।
গ. প্রতিটি মানুষকে সম্মান দিয়ে হেসে কথা বলবে।
সেদিনের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষ করে আনন্দময় অনুভূতিতে বাসায় ফিরেছি। ডিপার্টমেন্টের ম্যামের এমন আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আমাকে দারুণ ভাবে মুগ্ধ করেছে। সেদিনের পর থেকে আমি নিয়মিত রুটিন অনুযায়ী ক্লাসে যেতাম। এভাবে যতই দিন যাচ্ছে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সাথে একটা আত্মার সম্পর্ক তৈরি হতে বেশি সময় লাগেনি। বরাবরই ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষকদের পছন্দের তালিকায় নাম উঠে গেলো। তারমধ্যে জনাব খালেদা খানম ম্যামের বিশেষ আন্তরিকতায় আমি খুবই প্রফুল্লিত হতাম। আমি দুষ্টুমিতে ম্যামকে মাঝে মধ্যে আন্টি বলেও সম্বোধন করতাম। ম্যাম মৃদু হাসতেন।
আসলে শহর থেকে ৪০ কিমি দূরত্বে আম্মুকে মিস করার স্বাভাবিক ব্যাপারটা ম্যামের আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় মুছে যেতো। নিজের সন্তানের মতো করে সবকিছুই তদারকি করতেন, যেভাবে আম্মুরা সন্তানকে গুছিয়ে রাখেন।
বিগত ২ বছর ধরে আমি বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামে যুক্ত হয়েছি। ইতোমধ্যে মধ্যে অর্ধশতকেরও বেশি কলাম দেশের জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশ হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কলেজের নবনির্মিত ১০ তলা ভবনের লিফ্ট চালুকরণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আমার লেখা ১ টা প্রতিবেদন দেশের বেশ ক’টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা একযোগে প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে আছে– দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক আজাদী, দৈনিক কালবেলা এবং দৈনিক আজকের পত্রিকা। আমার লেখা এই প্রতিবেদনটি বেশ কার্যকরী ভাবে সাড়া ফেলেছে। চট্টগ্রাম কলেজের মাননীয় অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ স্যার সহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের কাছেও ব্যাপক উৎসাহ পেয়েছি। আমার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অনুভূতিতে জনাব খালেদা খানম ম্যামের উৎসাহ আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে।
এভাবে অনার্স ১ম বর্ষ, ২য় বর্ষ এবং ৩য় বর্ষের সময়টুকু দারুণ ভাবে কেটে গেলো। এই ৩ টা বছর আমি সর্বোচ্চ উপস্থিতির পুরষ্কারও পেলাম এবং নিদারুণ চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ফার্স্ট ক্লাসও পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। বর্তমানে আমি অনার্স ৪র্থ বর্ষে পড়ছি। ৪র্থ বর্ষের ক্লাসও প্রায় শেষের দিকে। খুব সম্ভবত চলতি বছরের মে মাসের দিকে ফাইনালও হয়ে যাবে। এদিকে আমার মায়ের শূন্যতা ভুলিয়ে ক্লাসে মনোযোগী করে তোলা আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব খালেদা খানম ম্যামের অবসরের চিঠি পৌঁছে গেলো। ক’দিন আগেই ম্যাম ডিপার্টমেন্ট থেকে বিদায় নিলেন। চলতি মাসের ১৪ তারিখে ম্যামের পি.আর.এল গমন জনিত বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জনাব খালেদা খানম ম্যাম
২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে গত ১৪ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত আপনার সান্নিধ্যে ছিলাম। গত ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ থেকে চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ আপনার শূন্যতায় হাহাকার। টিচার্স রুমে নিত্যদিনের মতো সেদিনও গিয়েছিলাম। আপনার ডেস্কের চেয়ারটি বড্ড শূন্য হয়ে পড়েছে। ডিপার্টমেন্টের কোথাও স্বস্তির ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাইনি। বড্ড মিস করছি আপনাকে। অবসরের অবকাশ ভালো কাটুক। যেখানেই থাকুন সুস্থ থাকুন এবং ভালো থাকুন। সর্বোপরি, আপনার সার্বিক সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।