গল্প

এখানে এখন অন্ধকার – জাকির আলম

নিকষ কালো অন্ধকারে একজন ছায়াবৃত্ত নারীর বিদগ্ধ হাসি শুনে জেগে উঠে উত্তাপ শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। তাকে ধরতে গেলেই ঢেকে যাই অবগুণ্ঠনে। প্রতিক্ষণে তার পায়ের ছাপ খুঁজতে গিয়ে পর্যবসিত হই শূন্যতার মেলবন্ধনে। তাকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণায় কুঁকড়ে যাই রতিক্রিয়ার তুমুল নেশায়। একগুচ্ছ বকুলের সুবাসিত নির্যাসে ঘুম আসেনা আঁখিপাতে ফুলের বিছানায়। ক্ষুধা কাতর অন্তরে ফুলের মধু পান করার ছলে হাতের আঙুলে আঁচড় মারি দণ্ডিত মুখচ্ছবিতে। ফাগুনের রাতে ভরা চাঁদের জোছনায় ভাসিয়ে দেই অস্থিমজ্জা কালবেলার স্রোতের আবাহনে। সন্ধ্যা হলেই গোধূলির ধূসর আভায় উড়ে যায় গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ পরিযায়ী পাখির বেশে। দখিনা সমীরণে পাল তোলা নৌকা ভেসে চলে উজান ঘাটে। অমাবস্যা রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের আস্তরণে দোল খেতে খেতে কিনারায় মিশে যায় কতো না কিশোরীর ঘাম ঝরানো পবিত্র ভালোবাসা। দুধের গাভীকে পরিচর্যায় হিন্দু বাড়ির নিমাই কাকা নব আশায় বুক বাঁধে দিবা স্বপ্নের মগ্নতায় আচ্ছন্ন থেকে। ডিভোর্সি মেয়ের মন খারাপের রাতগুলো নিঃসঙ্গতায় কাটে অসহায়ের দৌরাত্ম্যে। রোগাগ্রস্থ বৃদ্ধ দাঁতের ব্যথায় নির্ঘুম কাটায় জীবনের শেষ দিনগুলো। বিধবা মহিলা বেঁচে থাকার প্রত্যয়ে দু’মুঠো ভাতের আশায় ভিক্ষার ঝুলি কোমড়ে নিয়ে হেঁটে চলে পাড়া গাঁয়ের লোকের বাড়িতে। ধর্ষিত নারী লজ্জা নিরারণে লুকিয়ে থাকে ভিতর গৃহের চাতালে। সদ্য বিবাহিত নব বধূ স্বামীর সোহাগ পেতে ড্রিম লাইটের আলো জ্বেলে তুমুল আকর্ষণে জেগে থাকে উচ্ছ্বাস ভরা রাতগুলো। দিন মজুর বাবা টানাপোড়েন সংসারে সন্তানের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে কঠোর পরিশ্রমে নিরলস কাজ করে যান। ভোর হতেই পাখপাখালির কূজনে ঘুম ভাঙে পাড়া গাঁয়ের লোকের। একটু বেলা হতেই কৃষক ছোটে ফসলি জমিতে নতুন ফসলের পরিচর্যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই গৃহে ফিরে আসে রাখল বালক গরুর পাল নিয়ে। স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েগুলো বই হাতে ছুটে চলে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে। আঁকাবাঁকা পথেরধারে আম কাঁঠালের নিবিড় ছায়ায় গ্রীষ্মের দুপুরে খানিক বিশ্রাম নিতে ছুটে আসে খেতের দিন মজুর। কাঠ ফাটা রোদে ক্লান্ত পথিক নিরুদ্দেশে ছুটে চলে কাঁধে ব্যাগ তুলে হাতের লাঠিতে ভর করে। প্রকৃতির বুক জুড়ে হেমন্ত আসতেই বিরাজ করে নতুন ধানের আমেজ গৃহস্থালি বাড়িগুলোতে। দীর্ঘ অনাবৃষ্টির পর খরায় পুড়ে যাওয়া জমির ফসল পুনর্বার জেগে উঠে ঝুম বৃষ্টির শীতল পরশে। ব্যর্থ প্রেমিক ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে যখন অন্ধকার জগতে পা বাড়ায় পাড়া গাঁয়ের লোক তাকে বখাটে বলে সম্বোধন করে। অথচ তাকে ফাঁকি দিয়ে বেইমান প্রেমিকা অন্য পুরুষে মজে থাকে সবকিছু  ভুলে। মুহূর্তে ভুলে যায় অতীতের স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছেলেটি যখন বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে রাস্তায় বের হয় তখন কটুক্তি করতে ভুল করে না কিছু সমেত মানুষ। বৃদ্ধ বাবার সংসারে হাল ধরতে না পারার নিপীড়িত কষ্টে বুক ফেটে যায় বেকার যুবকের। তখন অসহায় বেকার যুবকের পাশে কেউ থাকে না। ভালো একটি চাকরির প্রত্যাশায় দিনের পর দিন বই হাতে বসে থাকে গুচ্ছে গুচ্ছে সাজানো বইয়ের টেবিলে। শুক্রবার এলেই ঢাকা শহরে ছুটতে হয় নতুন চাকরির পরীক্ষা দিতে। যে আশা নিয়ে পরীক্ষা দিতে যায় সেই আশার প্রতিফলন এতো পরিশ্রমেও না হলে দগ্ধ হতে থাকে নিয়তির কাছে৷ এই অভিশাপের হাত থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কখনো বা তারা বেছে নেয় অন্ধকার জগৎ। সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে বাবা-মায়ের মান সম্মান শিখেয় তুলে দেয়। সমাজে এখন মানবিক মানুষের ভীষণ অভাব। কারো ভালো কেউ চায় না। সবাই অন্যের সম্পদ ভোগ দখল করতে ব্যস্ত। দুর্নীতি আর অপকর্মে ক্রমাগত বেড়ে চলছে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। এদের রুখতে কেউ আসে না। বরং এই অপরাধে সামিল হয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ। অপরাজনীতিও জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। দেশ জুড়ে আতঙ্কের তাণ্ডব চলছে প্রতিনিয়ত। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পণ্যের দাম প্রতি মুহূর্তে বেড়েই চলেছে। এর প্রভাব পড়ছে দিন মজুরের সংসারে৷ সংসারের হাল ধরতে দিশেহারা হয়ে পড়ছে কতো না মানুষ। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতে ক্রমশ শরীরের ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। দেশ জুড়ে গরিব মানুষের মনে কষ্টের কোনো সীমা নেই। আজকাল কাকের দখলে মানুষের জঠর। ক্ষুধা নিবারণের অন্ন নেই। নদী বিধৌত মানুষগুলো বসত বাড়ি ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বছরের পর বছর। নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে বসতি ঘরগুলো। নদীর দখলে পড়ে যাচ্ছে ফসলি জমিগুলো। যার ফলে প্রতিনিয়ত অভাব অনটন বেড়েই চলেছে। কোথাও কোনো শান্তি নেই। চারদিকে শুধু  শোকের আহাজারি। চোখের জলে ভেসে রাত কাটে প্রান্তিক মানুষের। প্রতি বছর আগাম বন্যায় ডুবে যাচ্ছে জমির ফসল। অসহায় হয়ে পড়ছে গরিব কৃষক। এর প্রভাব পড়ছে পুরো দেশ জুড়ে। কোথাও শান্তির কোনো লেশ মাত্র নেই। জনমনে বিরাজ করছে অভাবের দুঃশ্চিন্তা। ক্রমশ বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। আশা ভরসা ম্লান হতে শুরু করেছে। মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে ভুলে যাচ্ছে। কেউ কেউ অভাবের তাড়নায় অল্প বয়সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। রোগ বালাই ক্রমানুসারে  বেড়েই চলেছে। চিকিৎসার ভার বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে গরিব মানুষ। হাসপাতালে বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী। পাশে বসে পরিবার পরিজন অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখছে সব। কিছু বলার ভাষা নেই। নীরব দৃষ্টিতে অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে বুকের পাঁজর। ক্রমশ নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। ধমনী থেকে উঠে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এমন জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। নিয়তির পরিহাস বড্ড ভয়ানক !

Related Articles

Back to top button